Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এগিয়ে গেছে ভিয়েতনাম, এ বছরেই ২য় স্থান পুনরুদ্ধারের প্রত্যয়


২৪ আগস্ট ২০২০ ১১:৪৫

ঢাকা: চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে করোনাভাইরাসের অভিঘাতসহ নানামুখী প্রভাবে পোশাক রফতানিতে বিশ্ব বাজারে দ্বিতীয় স্থান হারিয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি রফতানি করেছে ভিয়েতনাম, তারাই এখন পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। খাত সংশ্লিষ্টদের কারও কারও শঙ্কা, বছর শেষেও হয়তো তৃতীয় স্থানেই থাকতে হতে পারে বাংলাদেশকে। তবে বেশিরভাগ উদ্যোক্তার প্রত্যাশা, ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। বছর শেষে অন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বে পোশাক রফতানিতে চীনের অবস্থান প্রথম। কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশ রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। গেল কয়েক বছর ধরে তৃতীয় স্থানটি দখল করে রেখেছিল ভিয়েতনাম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি খুব দ্রুত এগিয়ে আসছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে রফতানি আয়ের ব্যবধানও কমছিল ক্রমেই। করেনাভাইরাসের সময়ে দেশের পোশাক কারখানাগুলো একের পর এক ক্রয়াদেশ হারালে রফতানি কমে যায় বাংলাদেশের। এই সুযোগেই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম। তবে বছর শেষে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) যে তথ্য প্রকাশ করে, তার ওপর নির্ভর করেই রফতানিতে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থান নির্ধারিত হয়। সেই হিসাবে এখনো বাংলাদেশ এই খাতে দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তথ্যপরিসংখ্যান যা বলছে

ডব্লিউটিও’র তথ্য অনুযায়ী, প্রথম অবস্থানে থাকা চীন ২০১৯ সালে বিশ্ব বাজারে পোশাক রফতানি করেছিল ১৫১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের। ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে দ্বিতীয় অবস্থান পায় বাংলাদেশ। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ৩০ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের।

এদিকে, দেশের পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনামের রফতানি ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময়টিতে বাংলাদেশকে পেরিয়ে যায় ভিয়েতনাম।

এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৩ ছিল হাজার ৩৯ মিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ২ হাজার ৪৭০ মিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের আয় ছিল ২ হাজার ৭৮৪ মিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের ২ হাজার ২২৩ মিলিয়ন ডলার। মার্চে বাংলাদেশের আয় ছিল ২ হাজার ২৫৬ মিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামের আয় ২ হাজার ৩৩৮ মিলিয়ন ডলার। বছরের প্রথম একক মাস হিসেবে করোনাকালীন এই মার্চে এসে রফতানি আয়ে প্রথমবারের মতো ভিয়েতনাম ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশকে। পরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের রফতানি তলানিতে ঠেকে। মাসটিতে বাংলাদেশ মাত্র ৩৭৪ মিলিয়ন ডলারের আয় করে, বিপরীতে ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ১ হাজার ৬০৯ মিলিয়ন ডলার। আর মে মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়ে ১ হাজার ২৩০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল আরও বেশি— ১ হাজার ৮৬৬ মিলিয়ন ডলার।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট ওই উদ্যোক্তাদের কাছে পরের মাসগুলো তূলনামূলক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অন্য একটি সূত্রের তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের আয় ছিল ১১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে তৈরি পোশাক খাত থেকে ভিয়েতনামের রফতানি আয় ছিল ৩০ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। সেখানে একই সময়ে বাংলাদেশের আয় ছিল ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে গত অর্থ বছরে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম প্রায় ৩ বিলিয়ন (২৯৬ কোটি ডলার) ডলার বেশি আয় করেছে।

যা বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা

জানতে চাইলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত জুন পর্যন্ত ভিয়েতনাম রফতানি আয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে আছে। কারণ করোনার সময়েও ওদের এখানে কারখানা চালু ছিল। বিপরীতে মার্চ ও এপ্রিল মাসে আমরা সর্বনিম্ন আয় করেছি। অনেক বায়ারই ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তবে জুন ও জুলাইয়ে আমাদের আয় ভালো হয়েছে। ছয় মাসে ওরা এগিয়ে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে আমরা পিছিয়ে গেছি। আমরা কাজ করছি। বছর শেষে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারব।’

নিট গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিয়েতনাম নীতিগত অনেকগুলো কারণে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। তাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাসে আমাদের চেয়ে খরচ কম। তাদের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী চীন, তাইওয়াং ও হংকংয়ের। চীন থেকে তাদের সুতা বা কাঁচামাল আনতে তিন থেকে চার দিন লাগে, সেখানে আমাদের সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ দিন। অর্থাৎ ওদের লিড টাইম কম। ফলে অল্প সময়ে পণ্য রফতানি করতে পারছে। এছাড়া ভিয়েতনামে কোনো শ্রমিক সংঘাত নেই। কথায় কথায় কাজ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। এছাড়া তারা উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরি করে। এসব কারণে তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।’

তাই বলে ভিয়েতনাম যে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়েই থাকবে, সেটি মনে করেন না মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘এরপরও আমাদের বিশ্বাস, আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। ওদের পেছনে ফেলতে আমাদের কিছু পলিসিগত সুবিধা দরকার। আর আমরা যদি একবছর টিকে থাকতে পারি, তাহলে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র পরিচালক (শ্রম) রেজওয়ান সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার সময়ে আমাদের রফতানি আয় যেমন কমেছে, তেমনি ভিয়েতনামেরও কমেছে। মার্চ এপ্রিলে আমাদের কাজ হয়নি। এছাড়া ঈদের ছুটি ছিল। আমাদের এখানে প্রায় এক থেকে দুই মাসের একটি বন্ধ ছিল। দুই মাসে প্রায় দুই বিলয়ন ডলারের রফতানি আয় আমাদের কমেছে। ওরা এখন ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার এগিয়ে আছে। এটি খুব একটি বড় পার্থক্য বলে মনে করি না। তবে বছর শেষে মনে হয় না আমরা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে পারব। হয়তো এই পার্থক্য এ বছর থেকেও যেতে পারে। আর সেপ্টেম্বর মাসটা গেলে বলা যাবে প্রকৃতপক্ষে ঘটনাগুলো কী ঘটছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের বাজার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে এই পরিচালক বলেন, ‘আমাদের বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের রফতানি আয় খুব কম হয়েছে, তা বলা যাবে না। কারণ ওদের এখানে তেমন বন্ধ ছিল না। ইউরোপের চেয়ে বরং আমেরিকার বাজারে রফতানি তখন ভালো ছিল।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিয়েতনামের পোশাক খাতে চীন, জাপান ও কোরিয়ার বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের এখানে নিজস্ব বিনিয়োগকারী। এছাড়া ভিয়েতনাম কাঁচামাল ও প্রযুক্তিগত সুবিধায় রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে তারা কতটুকু এগিয়ে গেল, কতটুকু এগিয়ে যাবে— এগুলো বলা যাবে আরও পরে। পৃথিবীতে এখনো করোনা রয়েছে। আমরা সাধারণ সময়ে ফিরে আসিনি। ফিরে এলে হয়তো আমরা আগের অবস্থানে দ্রুতই ফিরে আসব। আশা করি দ্রুতই আমরা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থানে ফিরে আসব।’

ভিয়েতনাম এ বছরের শেষেও দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেনও। সেই কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কারণ সম্প্রতি ৫৮টি দেশকে ট্রাভেলিং পারমিশন দিয়েছে ইংল্যান্ড। সেখানে বাংলাদেশ ও ভারত না থাকলেও ভিয়েতনাম রয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি হুমকি।’

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নতুন কৌশল নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমেরিকার বাজারে আমাদের ব্যবসা বাড়বে। কারণ সেখানে চীনাদের আধিপত্য কমছে। কিন্তু ওই বাজারে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম দুই দেশই রয়েছে। আমাদের এখন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে কোলাবরেশন বাড়াতে হবে— কাঁচামালের জন্য চীনের সঙ্গে ও প্রযুক্তির জন্য কোরিয়ার সঙ্গে। ভিয়েতনামের সফলতার পেছনে এই দুই দেশের সম্পৃক্ততাও একটি কারণ। আমার মনে হয় বাংলাদেশকে আরও বেশি প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। নিজেদের আরও উদ্যোগী হতে হবে, মার্কেটিংয়ে ডিজিটাল হতে হবে। সবকিছুর জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করলে নিজেদের যে উদ্যোগী সত্তা, তা বিলুপ্ত হবে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘চীন আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, তার জন্য সেখানে আমাদের রফতানি আয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের কারখানাগুলো এখনো পূর্ণ জনশক্তি নিয়ে চালু করতে পারিনি। আমাদের এখানে এখনো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। জনবল বাড়ানো যাচ্ছে না। তাহলে তো আমাদের উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়বে না।’

এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিয়েতনাম এগিয়ে গেছে, আমরা ছয় মাসে তাদের নিচের অবস্থানে নেমে গেছি— এ বিষয়গুলো আমার কাছে মুখ্য নয়। আমাদের মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হলো সক্ষমতা। ভিয়েতনাম এমনিতেই ভৌগলিক কারণে আমাদের চেয়ে এখন এগিয়ে রয়েছে। তাদের চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে যেমন সময় কম লাগছে, তেমিন রফতানিতেও সময় কম লাগছে। আমাদের ক্ষেত্রে সময় অনেক বেশি যাচ্ছে। এদিক থেকে ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে প্রাইস সক্ষমতায় রয়েছে। আবার ভিয়েতনামে চীনের অনেক যৌথ মূলধনী কোম্পানি রয়েছে। তারা দেখতেও অনেকটা চীনের মতো। এসব দিক থেকেও তারা সুবিধা পাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, এছাড়া করোনায় আমাদের এখানে কারখানা বন্ধ ছিল। প্রচুর শ্রমঘন আমাদের এই শিল্প। হতাহত যদি আরও বেশি হতো, তাহলে এই শিল্পের জন্য আরও বড় দুর্ঘটনা বয়ে আনত। উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করা উচিত এ কারণে যে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালানা করেছে। ফলে করোনায় এ খাতে আক্রান্ত ও হতাহত তেমনভাবে চোখে পড়েনি। সে কারণে ক্রেতারা আবারও ডিমান্ড দেখাচ্ছে। যেসব অর্ডার স্থগিত হয়েছিল, তার কিছু অংশ ফিরেও এসেছে। আর সরকারের প্রণোদনায় উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকরা তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ানোয়, সামনে যদিও দুই মাস খারাপ সময় রয়েছে, আমরা মনে করি আমাদের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারব। আমাদের এখন প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আরও বেশি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

পোশাক রফতানি বাংলাদেশ বিকেএমইএ বিজিএমইএ ভিয়েতনাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর