‘সহসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান দেখা যাচ্ছে না’
২৪ আগস্ট ২০২০ ২১:৩৫
ঢাকা: রোহিঙ্গা সংকট শুধু মানবিক সমস্যাই নয়, এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সমস্যা। খুব সহসা এই সংকটের সমাধান দেখা যাচ্ছে না। তবে সমাধানের জন্য দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, বহুপক্ষীয় কূটনীতিসহ ‘হাইব্রিড কূটনীতি’তে জোড় দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে রাখাইনে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার যে সুপারিশ করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সোমবার (২৪ আগস্ট) নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: পশ্চিমা, এশীয় ও দ্বিপক্ষীয় প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আলোচকরা এমন মন্তব্য করেন। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সিপিএস এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট কাটাতে হলে সবার আগে এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট শুধু আঞ্চলিক সমস্যাই নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যাও। এই সংকট শুধু মানবিক সমস্যাই নয়, এটি একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংকটও।’
বিপুল সংখক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি স্যালুট জানিয়ে মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, ‘এশিয়ার দেশগুলো এখনও এই সংকটের সমাধান করতে পারছে না। এখনও তাদের মধ্যে এটি ট্যাবু হিসেবে কাজ করছে। এ বিষয়ে আরও খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আর আসিয়ান থেকে ওআইসি’র প্লাটফর্ম এই সংকট মেটাতে উপযুক্ত আলোচনার স্থান। কেননা আসিয়ান এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো কথা না বলবে না- এই বিষয়ে একমত হয়েই এখানে যোগ দিয়েছে। আর ওআইসি হচ্ছে বহুপক্ষীয় ফোরাম। যেখানে এই সংকট নিয়ে আলোচনা করলে উপকার পাওয়া যাবে।’
খুব সহসা এই সংকটের সমাধান দেখছি না- উল্লেখ করে মালয়েশিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, ‘এই সংকট সমাধানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এই সংকট কাটাতে যাতে ভারত-চীন ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করে সেজন্য দেশ দুটিকে রাজি করাতে হবে। এই সংকটের নেতিবাচক বিষয়গুলো যেমন- মানবিক অধিকার হরণ, গণহত্যা এগুলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তভাবে তুলে ধরতে হবে।’
ওয়েবিনারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। সামনের দিনে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যহত রাখবে, যাতে করে সেখানে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত না হয়।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘কয়েক দশক আগে থেকেই মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বা বৈরী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উসকানি দিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভদ্রভাবে বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সৎভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও নেপিডোর সেনা সরকারের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ১৯৯১ সালে মিয়ানমার বাংলাদেশের বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) ৩ সদস্যকে হত্যা করেছে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশর সমুদ্রসীমায় ঢুকে খনিজ আহরণের চেষ্টা চালিয়েছে, ২০১৭ সালে মিয়ানমার ১৭বার বাংলাদেশের আকাশ সীমায় অনুমতি না নিয়ে ঢুকেছে এবং ২০১৮ সালে সেন্টমার্টিনকে তাদের বলে মিয়ানমারের মানচিত্রে দেখানোর চেষ্টা করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র নীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়- এই নীতিতে বিশ্বাস করে। কিন্তু মিয়ানমারের কারণে এই অঞ্চলে অস্থিরতার সৃষ্টি হলে বাংলাদেশ বসে থাকবে না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তি, ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং ২০১৮ সালের ১৫ থেকে ১৬ জানুয়ারি দুদিনব্যাপী বৈঠকে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত বিষয় সই হয়েছে। কিন্তু তিন বছর হতে চলল মিয়ানমার এখনও এগুলোর কোনোটিই মানেনি।’
শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো ইচ্ছা ছাড়াই শান্তি আলোচনায় মিয়ানমার অংশ নিয়েছে জানিয়ে উল্লেখ করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘এই সংকট সমাধানের জন্য দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক, বহুপাক্ষিক ফোরামে আলোচনাসহ হাইব্রিড কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। বৈশ্বিক আদালত আইসিজি এবং আইসিসি যাতে এই সংকট কাটাতে যথাযথভাবে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে, সেজন্য কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনে রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার যে সুপারিশ করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করলেও এই সংকট সমাধান হবে।’
কানাডার হাইকমিশনার বেনোয়া প্রিফন্টেইন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট খুব মর্মান্তিক এবং অমানবিক এক ঘটনা। জরুরিভাবে এই সংকটের সমাধান করা প্রয়োজন। কানাডা এই সংকট কাটাতে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে আরও জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।’
ওয়েবিনারে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আত্মীকরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এ ধরনের কোন পরিকল্পনা নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। কারণ এতে করে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। তবে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পরে রোহিঙ্গারা যেন জীবিকা অর্জন করতে পারে সে জন্য ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মিয়ানমারের কারিকুলামে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে ৮ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।