কাজে আসছে না ড্রেজিং, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ীতে ফেরি বন্ধ ৯ম দিনে
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:৩১
মুন্সীগঞ্জ: নাব্য সংকটে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে টানা নবম দিনের মতো ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফেরি বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার হাজার হাজার যাত্রীকে। সেইসঙ্গে আর্থিক সংকট বিবেচনায় পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যানগুলোকে দিনের পর দিন ঘাটে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাব্য সংকট মোকাবিলায় মাস তিনেক হলো ড্রেজিং চললেও তা কোনো কাজে আসছে না। এ অবস্থায় কতদিন ধরে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে, তা বলতে পারছেন না কেউ। তবে লৌহজং চ্যানেলে ড্রেজিং প্রায় শেষ হওয়ায় আজ শুক্রবারও সীমিত আকারে ফেরি চলাচল শুরু হতে পারে জানিয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশ (বিআইডব্লিউটিসি)।
এই নৌরুট টানা বন্ধ থাকায় অবশ্য যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস বিকল্প রুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দিয়ে পারাপার করছে। তারপরও যাত্রীর চাপ তেমন একটা কমেনি শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়িতে। এই নৌরুটে কিছু লঞ্চ চললেও তা যাত্রীদের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। অনেকেই ঝুঁকি থাকলেও স্পিড বোটে পার হচ্ছেন প্রমত্ত পদ্মা। যাত্রীর চাপ অনেক বেশি থাকায় লঞ্চ ও স্পিড বোটে যাত্রীও উঠছে নির্ধারিত মাত্রার বেশি। তাতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ছে।
এদিকে, পারাপারের অপেক্ষায় থাকা শতাধিক ট্রাক ও পিকআপের দুর্ভোগ ঠেকেছে চরমে। পণ্যবাহী ট্রাকের চালকরা অনেকেই বলছে, অর্থ সংকটে গাড়ি ঘুরিয়ে পাটুরিয়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে পারছেন না। ফলে ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যানে পণ্য নিয়ে পদ্মা পাড়ে তাতেই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়েছে তাদের।
ট্রাকচালকরা বলছেন, গন্তব্যে পণ্য পৌঁছাতে পারলে যে ভাড়া পাওয়া যাবে তার বেশিরভাগই খরচ হয়ে গেছে এবারের ট্রিপে। এবার লাভের বদলে লোকসান গুনতে হবে। ঘাট এলাকায় খাবারের দামও অনেক বেশি। খুব কষ্টে কোনোরকম দিন পার করছি।
বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি বলছে, লৌহজং টার্নিংয়ের পৌনে ২ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হয়েছে, যার গভীরতা ১৫ ফুট। কাজ শেষ হলে আজ শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরের পর চলমান বিড়ম্বনার কিছুটা হলেও সমাধান মিলতে পারে।
পদ্মার চ্যানেলে নাব্য সংকটে গত ২৯ আগস্ট থেকেই রাতে ফেরি বন্ধ এবং ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই রুটে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই নৌরুটের ১৭টি ফেরির মধ্যে দুইটি রোরোসহ চারটি ফেরি অন্য রুটে পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৩টি ফেরি ঘাটে অলস বসে আছে। তবে বিআইডব্লিউটিসি’র মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আতিকুজ্জামান জানান, ফেরি চলাচল শুরু হলে ফেরিগুলো ফিরিয়ে আনা হবে এই রুটে।
ড্রেজিং হলেও মিলছে না সুফল
পদ্মার এই অংশে নাব্য সংকটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। এর মধ্যে নাব্য সংকট নিরসনে ড্রেজিং কার্যক্রমও চলছে প্রায় তিন মাস হলো। তবে তা কোনো কাজে আসছে না। গত জুন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে পর শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে চলাচলরত ফেরির একাধিক চালক ও বিআইডব্লিউটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, গত তিন মাস ধরে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজারগুলোর মাধ্যমে পলি কেটে তা ফেলা হচ্ছে পদ্মার চরের ধারে ও চ্যানেলের আশপাশেই। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবারও পলি জমে নাব্য সংকট দেখা দিচ্ছে।
ফেরিচালকদের অভিমত, চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না সিনোহাইড্রোর ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিংয়ের সময় তুলে ফেলা পলিমাটি পদ্মা চরের মাঝখানে ফেলা হয়। ফলে সেগুলো নদীর পানিতে মেশার সুযোগ পায় না। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজারগুলো যেখানে ড্রেজিং করে, তার পাশেই পলিমাটি ফেলে। ফলে এটা কোনো কাজে আসছে না।
এ অভিযোগ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের দাবি, নদী খননের পর পলিমাটি ফেলার জায়গা নেই। তাই নদীর পাড়েই পলিমাটি ফেলতে হচ্ছে তাদের। তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বিআইডব্লিউটিসি’র সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) শফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে নৌচ্যানেলে ৯টি ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিং করছে বিআইডব্লিউটিএ। ড্রেজিং করে পলিমাটিগুলো দূরে ফেলা হলে ভালো হয়। কিন্তু তারা পাশেই ফেলছে।
শফিকুল ইসলাম জানান, নাব্য সংকটের কারণে গত রোববার দ্বিতীয় দফায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে লৌহজং টার্নিং চ্যানেলে ড্রেজিং করা হচ্ছে। লৌহজং চ্যানেলের প্রবেশমুখ ও আশপাশের এলাকায় ৯টি ড্রেজার এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র একাধিক প্রকৌশলী (ড্রেজিং) জানান, পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজে অধিগ্রহণ করা জায়গায় চীনা প্রতিষ্ঠান ড্রেজিংয়ের পলিমাটি ফেলছে। সেখানে তাদের পলিমাটি ফেলতে দেওয়া হয় না। আর মাটি ফেলার জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র নিজস্ব উঁচু কোনো জায়গাও নেই। নৌযান চলাচলের বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিবছরই চরের পাশেই পলি ফেলতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিমুলিয়া-কাঠাঁলবাড়ী নৌরুটে নাব্যতা সংকট নিরসন করতে গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাসে ৫ লাখ ৬০ হাজার ঘনমিটার পলি অপসারণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এতে খরচ হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। কিন্তু তীরে ফেলা পলিমাটি ফের স্রোতের সঙ্গে মিশে নদীতে চলে যাওয়ায় সরকারের কোষাগারের এই টাকা স্রেফ জলে যাচ্ছে। ফলে অব্যাহতভাবে ড্রেজিং চালিয়ে গেলেও নাব্য সংকট কাটছে না। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই রুটের ৩৩ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করতে হবে বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
ডেজিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে প্রচুর পলি আসায় নৌপথটি সচল রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়। এ বছর ৩২ লাখ ঘন ফুট পলি নদী থেকে অপসারণের লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্যে জুন থেকে ২০২১-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে নদী খননের কাজ। এ অবস্থায় পালের চরের পথটি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মনে করছে বিআইডব্লিউটিএ।
ড্রেজিং নাব্য-সংকট নৌরুট ফেরি চলাচল বন্ধ শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী