ঢাকা: ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের নিয়োগ ‘বিতর্কিত’ এবং তাকে একাধিকবার পুনঃনিয়োগের প্রক্রিয়াকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাকসিম এ খানকেই ফের ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে পুনঃনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডাকা বোর্ড সভারও নিন্দা জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। তাকসিম এ খানের পরিবর্তে টিআইবি ঢাকা ওয়াসায় নতুন এমডি নিয়োগের দাবি জানিয়েছে।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি’র পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়েছে। আজ বিকেল ৫টায় ডাকা ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের ৯৭তম বিশেষ সভা প্রসঙ্গে এ বক্তব্য দিয়েছে টিআইবি। ওয়াসার বিশেষ বোর্ড সভার এই নোটিশে বলা হয়েছে, সভার একমাত্র আলোচ্যসূচি— প্রতিষ্ঠানটির এমডি পদে প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে তিন বছরের জন্য নিয়োগের প্রস্তাব স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো।
ঢাকা ওয়াসার এ উদ্যোগের বিরোধিতা জানিয়ে টিআইবি বলছে, বর্তমান এমডিকে অনৈতিক ও বিধিবহির্ভূতভাবে পুনঃনিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আজ (শনিবার) ঢাকা ওয়াসা বোর্ড যে বিশেষ বৈঠকে বসতে যাচ্ছে, তা দুর্নীতির সুরক্ষামূলক উদ্যোগ। সভার আলোচ্যসূচির ভাষায় এটি স্পষ্ট— বরাবরের মতো এবারও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ঢাকা ওয়াসার শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় একই ব্যক্তির অনৈতিক ও অবৈধ বহাল অব্যাহত রেখে দীর্ঘকালের লালিত এককেন্দ্রিক আধিপত্যবাদ অপরিবর্তিত রাখার সব ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছে। ধারাবাহিক ব্যর্থতা ও অনিয়মের গুরুতর সব অভিযোগ থাকার পরও এই পদে প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ ও অব্যাহত পুনঃনিয়োগ ওয়াসায় শুদ্ধাচার তথা সার্বিকভাবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারকে প্রহসনে পরিণত করেছে বলে মনে করে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণমাধ্যম ও নির্ভরযোগ্য প্রত্যক্ষ তথ্য সূত্র অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার বোর্ডের বিশেষ সভায় শুধু বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম উল্লেখ করে তাকে আবারও তিন বছর মেয়াদে পুনঃনিয়োগের সুপারিশ চূড়ান্ত করার কথা বলা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এই পদে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছিল কি না, কারা আবেদন করেছিলেন, কেন তারা যোগ্য বিবেচিত হলেন না বা কেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকই একমাত্র উপযুক্ত প্রার্থী, কেন সংশ্লিষ্ট বিধি অবমাননা করে মেয়াদের পর মেয়াদ একই ব্যক্তিকে নবায়ন দান অপরিহার্য— এসব প্রক্রিয়াগত প্রশ্নের উত্তর যাচাই করা হয়েছে কি না, তার কোনো উল্লেখ নেই।
তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রায় দশকব্যাপী দায়িত্বকালে জনদুর্ভোগের বিষয়টি কারও অজানা নয়। টিআইবির গবেষণা ও নির্ভরযোগ্য সংশ্লিষ্ট সব সূত্রে ওয়াসার ছোট-বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সেবা পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভূতপূর্ব বিস্তারের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তার কোনো কোনো বিষয় তদন্তাধীন। আমরা আশা করেছিলাম, সরকারপ্রধান যেখানে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’র কথা বলছেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তখন এর একটা সুরাহা হবে। কিন্তু ঘটনা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আমরা আর হতাশার কথা বলতে পারছি না। আমরা এখন ওয়াসায় শুদ্ধাচার বা সুশাসনের সম্ভাবনার কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছি এবং এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও সুরক্ষাকারী তোড়জোড়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এই পথ পরিহারের জন্য মন্ত্রণালয় ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ড. জামান বলেন, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিতর্কিত নিয়োগের পর প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় টানা পাঁচ মেয়াদে ১১ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, প্রতিবারই তার নিয়োগ নবায়নের ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে আইন ও নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে। এমনকি প্রথমবার নিয়োগের সময়ই অনিয়মের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য দালিলিক নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপরও কখনো বয়সসীমা বাড়িয়ে, আবার কখনো বোর্ডের সাম্প্রতিক সভার সুপারিশ পাশ কাটিয়ে পুরনো সভার তামাদি সুপারিশ ব্যবহার করে, এমনকি বোর্ডের মতামত গ্রহণেরই তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে তার পুনঃনিয়োগ নিশ্চিত করা হয়। এমনকি একটি ক্ষেত্রে একজন বিতর্কের ঊর্ধ্বে মন্ত্রীর লিখিত নির্দেশও অমান্য করা হয়। এগুলো শুধু আইনেরই সুস্পষ্ট ব্যত্যয় নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার ও যোগসাজশের সংস্কৃতির নির্লজ্জ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দৃষ্টান্ত।
আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদ আগামী ১৪ অক্টোবর শেষ হওয়ার আগেই যথানিয়মে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট খাতে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। একইসঙ্গে এই সংস্থার এবং এর সেবাগ্রহীতা জনগণের কল্যাণে বর্তমান এমডি’র প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ ও অব্যাহত পুনঃনিয়োগ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নিরীক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি ওয়াসার সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের সুষ্ঠু তদন্ত করে অনিয়ম ও দুর্নীতির জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটা নিশ্চিত যে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করছে না বা করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, বিশেষ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধে অপারগতার কারণে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডেরও অপসারণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি জানাই।