‘খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ’
২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:৩১
ঢাকা: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বার বার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে এই বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক প্রভাব। অপরটি হচ্ছে, তদারকি ও নেতৃত্ব সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি।
মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) সংস্থাটি পক্ষ থেকে ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন এই মন্তব্য করা হয়েছে। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মোহামম্মদ রফিকুল হাসান। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, পরিচালক জনসংযোগ শেখ মঞ্জুর ই আলম উপস্থিত ছিলেন।
গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের সময়কাল ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত। গবেষণায় ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত উল্লিখিত কার্যক্রমসমূহ বিবেচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা সহয়, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এই সময়ে বছরে গড়ে ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ, যদিও একই সময়ে মোট ঋণ বৃদ্ধির হার ৩১২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী জুন ২০১৯ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের (১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা) সাথে বারবার পুনর্গঠিত ও পুনঃতফসিলীকৃত এবং উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত খেলাপি ঋণ যোগ করে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। অপর একটি প্রতিবেদন অনুসারে আইএমএফ‘র খেলাপি ঋণের এই পরিমাণের সাথে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ (৫৪ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা) যোগ করে জুন ২০১৯ পর্যন্ত প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ ঋণ বর্তমান ব্যাংকিং খাতে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র দুই শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়। এভাবে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই সেপ্টেম্বর ২০১৯ হতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান ও খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিবিধ কৌশল অবলম্বনের পরও জুন ২০২০-এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাত কার্যকর তদারকির জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন তদারকি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে ব্যাংক খাত তদারকি ও ঋণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনটি বাধা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি কাঠামোর কিছু সীমাবদ্ধতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাকে সীমিত করে এবং ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ; ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ব্যবসায়ী অংশ কর্তৃক তাদের ইচ্ছে অনুসারে আইন পরিবর্তন, ব্যাংকিং খাতে ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতাকে খর্ব করা।
তৃতীয়ত, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব; একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, তাদের ইচ্ছে অনুসারে ব্যাংকিং নীতি প্রণয়ন ও পরিবর্তন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করা, তদারকি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা ও আইনের লঙ্ঘন এবং ঋণ গ্রহণে সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা খর্ব করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একক ব্যক্তি বা গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ ঋণ সংগ্রহ করতে পারবে তা একক বৃহত্তম ঋণ সীমা নীতিমালায় নির্ধারিত করা আছে। তবে একক ব্যক্তি বা গ্রুপ সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাত হতে কী পরিমাণ ঋণ সংগ্রহ করতে পারবে সে বিষয়টি উল্লেখ নেই। আর উল্লেখ না থাকার সুযোগে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা বিভিন্ন কৌশল ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হতে ঋণ বের করে নিচ্ছেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ পরবর্তিতে খেলাপি হয়ে পড়ছে। বর্তমানে ৭ বা ১০ জন শীর্ষ ঋণ গ্রহীতা খেলাপি হলে যথাক্রমে ৩৫টি এবং ৩৭টি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ও তদারকি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের পর থেকে ১৪টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবিত/বাধ্য করা হয়। নতুন ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তার মধ্যে মন্ত্রী, সাংসদ ও তাদের পরিবারের সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, ছাত্রসংগঠনের নেতা, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ উল্লেখযোগ্য।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ খেলাপিদের পৃষ্টপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যা করণীয় তা করছে না।