‘অর্থনৈতিক উন্নয়নে লজিস্টিক সুবিধা বাড়াতে হবে’
২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:১২
ঢাকা: দেশের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়নে লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোসহ দ্রুততম সময়ে লজিস্টিক নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। এজন্য বাণিজ্য বিয়ষক সংষ্কার কাজগুলো এগিয়ে নিতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি করা যেতে পারে বলেও মনে করেন তারা।
মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘লজিস্টিকস: বাংলাদেশের আন্তঃবাণিজ্যের বর্তমান প্রেক্ষিত ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
এছাড়া সব স্টেকহোল্ডার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য একক সংস্থা গঠন, বন্দরসমূহে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ার অটোমেশন, বন্দরের সঙ্গে সড়ক, রেল ও নদীপথের যোগযোগ উন্নয়নসহ উন্নতদেশসমূহের ন্যায় ‘লজিস্টিক ও ওয়ারহাউস পার্ক’ স্থাপন করা দরকার বলেও জানান তারা।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সেবা নিশ্চিতকরতে আমাদের একটি নিজস্ব মানদণ্ড থাকতে হবে এবং প্রতিনিয়ত তা নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেবাসমূহে আমাদের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান আরও উন্নত করা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বচ্ছতা ও ইফিসিয়েন্সি বেশি না। মাত্র ১২টি কন্টেইনার শিপ আছে। আমরা শুধু বিশ্বব্যাংককে দোষ দিই কেন? বিনিয়োগকারীদের আনতে তাদের চাহিদা পরিপূর্ণ করতে হবে। নিজেদের ভালো আমরা দেখি না। ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের যে অসামঞ্জস্যতা তা দূর করতে হবে। সকলে মিলে যদি সম্মিলিতভাবে লজিস্টিক নিয়ে কথা বলি, প্রতিমাসে আমাদের সমস্যাগুলি ট্রাক করি তাহলেই অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।‘
রুবানা হক আরও বলেন, ‘বন্ডেড লাইসেন্স-এর মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে, যার এর অপব্যবহার করছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাণিজ্য বিয়ষক সংষ্কার কাজগুলো গুছিয়ে উপস্থাপনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কমিটি প্রণয়ন করা আবশ্যক।’ এছাড়া তিনি কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণ, আশিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা আরও বাড়ানো এবং আশিয়ান প্লাস ওয়ান নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি লজিস্টিক প্রক্রিয়া সহজীকরণের ওপর জোর দেন।
স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘লজিস্টিক আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যে সময়মত এবং কম খরচে পণ্য ও সেবা সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামোখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেও বাংলাদেশ লজিস্টিক ব্যবস্থাপনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে। করোনা মহামারির সময়ে অপর্যাপ্ত লজিস্টিক সুবিধার কারণে চলতি বছরে আমাদের রফতানি প্রায় ১৭ শতাংশ কমে গেছে, যেখানে বৈশ্বিক বাণিজ্যে এর পরিমাণ প্রায় শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক লজিস্টিক সূচক ২০১৮’ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১০০ এবং এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী এশিয়ার অন্যান্য দেশসমূহের তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিসিসিআই পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, কোভিড মাহামারির কারণে ৪২ শতাংশ উদ্যোক্তা মনে করেন, ফ্যাক্টরি থেকে সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ১৫ দিনের বেশি সময় প্রয়োজন হয় এবং ৬২ শতাংশ উদ্যোক্তার সমুদ্র বন্দর থেকে কারখানা পর্যন্ত পণ্য আমদানিতে ১৫ দিনের বেশি সময় লেগেছে বলে মত প্রকাশ করেন। এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী উদ্যোক্তারা আরও মনে করেন, বন্দরসমূহে কন্টেইনার জট, পোর্ট ডেমারেজ চার্জ, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে দীর্ঘসূত্রিতা, অপর্যাপ্ত বন্দর অবকাঠামো প্রভৃতি বিষয়গুলো ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।’
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক-এর তথ্যমতে রাস্তাঘাটে যানজট নিরসন ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা উন্নয়ন করা গেলে ব্যবসা পরিচালনায় প্রায় ৭-৩৫ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব।’
তিনি জানান, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভরশীল হলেও আমাদের বন্দরসমূহ এখনো পুরোনো প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। দেশের কাঙিক্ষত অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে দেশের বন্দরসমূহে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ার অটোমেশনসহ বন্দরে কন্টেইনার ধারণ সক্ষমতা বৃদ্ধি, গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, লজিস্টিক নীতিমালা প্রণয়নে সরকারি সংস্থা, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারিখাতের মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো, উন্নতদেশসমূহের ন্যায় ‘লজিস্টিক ও ওয়ারহাউস পার্ক’ স্থাপন এবং আমদানীকৃত কাঁচামাল সংরক্ষণে বন্ডেড ওয়ারহাউস স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের ‘লজিস্টিক পারফর্মেন্স সূচক’-এর প্রধানত কাস্টমস, অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক শিপমেন্ট, লজিস্টিক মান ও দক্ষতা, ট্রাকিং অ্যান্ড ট্রেসিং এবং সময়পোযোগীতা-এ ছয়টি বিষয়টিকে বিবেচনা করা হয়। লজিস্টিক সেবা প্রদানে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে এবং লজিস্টিক সুবিধা প্রাপ্তির অভাবে আমাদের রফতানি বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে লজিস্টিক সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, বৈদিশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে লজিস্টিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নের আবশ্যক, যদিও ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উল্লেখজনক হারে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। লজিস্টিক খাতে বর্তমান অবস্থা উন্নয়নে সকল বন্দরসমূহে অটোমেশন ব্যবস্থা চালু, ক্লিয়ারিং ও পেমেন্ট ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন, সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বয় বৃদ্ধি ও বন্দরের কার্য পদ্ধতির সহজীকরণ, বন্দরের অবকাঠামোর আধুনিকায়নসহ রেলপথ ও নদীপথের আধুনিকায়নের প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট-এর অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার সামির সাত্তার, পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (পিআরআই)-এর চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর সভাপতি মাহবুবুল আলম, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ-এর সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর ফার্স্ট সেক্রেটারি (কাস্টম অ্যান্ড ভ্যাট) মো. আকবর হোসেন।