‘পাকিস্তানি লবিতে পরিবেষ্টিত’ ড. কামাল, ভাঙছে গণফোরাম
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:১৬
ঢাকা: ২৭ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আদর্শ ও নীতি নিয়ে প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে গণফোরাম। দীর্ঘ ২৭ বছরে রাজনৈতিকভাবে খুব বেশি অর্জন না থাকলেও ড. কামালের নেতৃত্বে গণফোরাম একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই পরিচিত ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রায় তিন দশক পর এসে ভাঙনের মুখোমুখি সেই দলটি। এরই মধ্যে দলের একাংশ আহ্বান করেছে বর্ধিত সভা, যেখান থেকে নতুন কমিটি ঘোষণা হতে পারে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
ড. কামালের নেতৃত্বকে অস্বীকার করে বেরিয়ে আসা দলের এই অংশের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে দলটি। তারা এখন বিদেশি পরামর্শে পরিচালিত হচ্ছে। এ নিয়ে দলের বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা তা পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। দলের ভেতরে কোন্দল থাকলেও তা নিরসনে কোনো উদ্যোগও নিচ্ছে না শীর্ষ নেতৃত্ব। শুধু তাই নয়, দলের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে পাকিস্তানপন্থি লবির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর।
গত বছর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর থেকেই গণফোরামের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য হতে শুরু করে। তার জের ধরে এ বছরের শুরুর দিকে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে ড. কামাল হোসেন কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এরপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হলে উভয় পক্ষই রাজনৈতিক তৎরতায় স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে গত আগস্ট থেকে ফের একাংশ তৎপর হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে আগামীকাল শনিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দলের বর্ধিত সভা আহ্বান করেছে দলের এই অংশটি।
দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক খান সিদ্দিকুর রহমানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শনিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ, নির্বাহী সভাপতি ও মুখপাত্র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এতে উপস্থিত থাকবেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই সভা থেকেই সুব্রত চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. আবু সাইয়িদকে সাধারণ সম্পাদক রেখে নতুন কমিটির ঘোষণা আসতে পারে।
গণফোরামের ‘বিদ্রোহী’ গ্রুপের নেতা লতিফুর রহমান হামীম অবশ্য সরাসরি কমিটি ঘোষণার তথ্য দিচ্ছেন না। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্ধিত সভা থেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হবে।’ ‘বিদ্রোহী’ গ্রুপটির আরেকজন নেতা জানান, বর্ধিত সভার একমাস পর গণফোরামের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘৭/৮ জন লোক দলের গঠনতন্ত্র অমান্য করে দলটির মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। ওরা দলে না থাকলে বা দল থেকে বেরিয়ে গেলে গণফোরামের কোনো ক্ষতি হবে না।’ দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দলটির কাউন্সিল করা হবে বলে জানান তিনি।
দলের একাধিক নেতার অভিযোগ, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গই শুধু নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও ড. কামালকে লিয়াজোঁ করে চলার পথ তৈরি করে দিতে কাজ করছেন কেউ কেউ। লতিফুর রহমান হামীম সরাসরি অভিযোগ করে সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত নির্বাচনকে (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন) কেন্দ্র করে গণফোরামে আসা পাকিস্তানপন্থিদের দ্বারা ড. কামাল হোসেন পরিবেষ্টিত ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। রেজা কিবরিয়া, মহসীন রশিদ, মোস্তাকের মতো নেতারা পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত ও পাকিস্তানি লবির সঙ্গে ড. কামালের বৈঠক করিয়ে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা নিয়ে ব্যস্ত।’ দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক রয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেউ কেউ।
তার বিরুদ্ধে ‘বিএনপিতে বিলীন হয়ে যাওয়া’র যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ড. কামাল বলেন, ‘এ অভিযোগ ঠিক না।’ পাকিস্তান লবি’র সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব বাজে কথা। আমি এসব বিষয়ে কিছু বলতেও চাই না, এসব কথা শুনতেও চাই না।’
দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে, গত ২৭ বছরে গণফোরাম সারাদেশে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি। ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা লাকসাম, রংপুরসহ মোট ৪০টি জেলায় দলের কমিটি রয়েছে, যেগুলো গণফোরাম প্রতিষ্ঠার পরপরই গঠন করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. কামাল হোসেনের কাছ থেকে সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সারাদেশে দলটির কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। কারণ ড. কামাল হোসেন কখনো সরব, কখনো নীরব ভূমিকা পালন করে থাকেন।
নেতাকর্মীরা আরও বলছেন, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণফোরাম তার নীতি আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি জোট গড়ে তোলে। এরপর থেকেই গণফোরাম চলছে বিএনপির প্রেসক্রিপশনে। দলটির মধ্যে এমন গুঞ্জনও রয়েছে— দল পরিচালনার পরামর্শ আসে লন্ডন থেকে। এ নিয়ে গণফোরামের মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ নেতাদের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের একাধিকবার আলোচনা ও তর্ক হয়েছে। কিন্তু ড. কামাল হোসেনের অবস্থানের নড়চড় হয়নি বলেই বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিদ্রোহী নেতা।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, অ্যাডভোকেট সুব্রত ও মোস্তফা মোহসীন মন্টুর মতো কেন্দ্রীয় নেতারা পক্ষ ত্যাগ করলে ড. কামাল হোসেন কার্যত অসহায় হয়ে পড়বেন। বাকিদের নিয়ে দল টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা হারাবেন তিনি।
তবে দলের এই অংশটিকে পাত্তা দিতে নারাজ এখনকার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব রেজা কিবরিয়া। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, কেরাণীগঞ্জ ও এলিফ্যান্ট রোডের কিছু লোক দিয়ে গণফোরাম চলে না। গণফোরামের সারাদেশে নেতাকর্মী রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ছয় সপ্তাহের মধ্যে কাউন্সিল করে দলকে শক্তিশালী করা হবে। দলীয় গঠনতন্ত্রের বাইরে কোনো কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়।
এর আগে, গত বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর থেকেই মূলত গণফোরামের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিতে থাকে। এই কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছায় এ বছরের মার্চের শুরুর দিকে। গত ২ মার্চ দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশতাক আহমেদের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে দুই সাংগঠনিক সম্পাদকসহ চার কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এই চার নেতা হলেন— সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন ও লতিফুল বারী হামিম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক খান সিদ্দিকুর রহমান এবং প্রবাসীকল্যাণ সম্পাদক আব্দুল হাছিব চৌধুরী। পরদিন ৩ মার্চ ওই বহিষ্কৃত চার নেতা বহিষ্কার করেন দলের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, সহসভাপতি মহসীন রশীদ ও সহসভাপতি শফিকউল্লাহ এবং যুগ্ম সাধারণ মোস্তাককে।
পাল্টাপাল্টি এই বহিষ্কারের পর ৪ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তিতে গণফোরামের চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। নিজেকে আহ্বায়ক ও আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়াকে সম্পাদক রেখে ওই বিজ্ঞপ্তিতে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন তিনি। পরে ১২ মার্চ পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করেন তিনি। ওই সময়ও দলের একাংশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, অগণতান্ত্রিকভাবে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ড. কামাল হোসেনকে ২ সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেন। পরে অবশ্য দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর সাধারণ ছুটি ঘোষণা হলে গণফোরামের উভয় পক্ষের রাজনৈতিক তৎপরতাও স্থবির হয়ে পড়ে। বর্ধিত সভার ঘোষণায় ফের সেই স্থবির দশা কাটতে যাচ্ছে।
অ্যাডভোকেট সুব্রত গণফোরাম ড. কামাল হোসেন দলে ভাঙন বর্ধিত সভা মোস্তফা মোহসীন মন্টু রেজা কিবরিয়া