পূর্বাচলে বাণিজ্যমেলা: পিছু ছাড়েনি জটিলতা, হয়নি জমি রেজিস্ট্রেশন
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:২৬
ঢাকা: জমি জটিলতা পিছু ছাড়ছে না রাজধানীতে নির্মিতব্য স্থায়ী বাণিজ্যমেলা কেন্দ্রের। শুরুতেই ছিল জমি নিয়ে চরম সংকট। এখন শেষ শেষ পর্যায়ে এসে বিল্ডিং নির্মাণ হলেও জমির রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যায়নি। ফলে দেখা দিচ্ছে অনেক সমস্যা। তবে আগামী ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল রাজধানীর পূর্বাচলে ‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ’ কাজ।
করোনা মহামারীর কারণে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ফের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে আরও এক বছর (২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত)। তবে চীনের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গত ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে সেন্টারটির সব কাজ সম্পন্ন করা কথা ছিল। সেটি না হওয়ায় এখন নতুন করে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা হচ্ছে। গত ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায় এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। গত ১৫ সপ্টেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী জারি করা হয়।
সূত্র জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এ প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করে। সেসময় এটি তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরের উত্তর-পঞ্চিম কর্ণারে খালি জায়গায় তৈরির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২৭৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে চীন সরকারের অনুদান হিসেবে দেয়ার কথা ছিল ২১০ কোটি টাকা এবং বাকি ৬৫ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করার কথা।
২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পায়। কিন্তু সেসময় তৈরি হয় জমি নয়ে সংকট। জমি না পাওয়ায় সেসময় বাস্তবায়ন শুরু করা যায়নি। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পূর্বাচল উপ-শহরে মোট ২০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। সে অনুযায়ী ডিজাইনও করা হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ভূ-গর্ভস্থ কার পার্কিং নিয়ে। একনেকের নির্দেশনা মেনে ভূ-গর্ভস্থ কার পার্কিং করতে গেলে অর্থনৈতিক ও কারিগরি কোনোদিক থেকেই যৌক্তিক হতো না। ফলে ডিজাইন পরিবর্তন করে উপরে কার পার্কিং ধরা হয়। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ৪ আগষ্ট আবারো একনেক অনুমোদন দেওয়া হয় প্রকল্পটি। সর্বশেষ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৭৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের অনুদান ৬২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং সরকারি তহবিলের ১৭০ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পর জন্য অতিরিক্ত ১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ, নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ,সেন্টারের পরিসর বৃদ্ধিসহ সেন্টারের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাকরণসহ বিভিন্ন ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে মেয়াদ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
পিআইসি সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, ওই সভায় প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছিলেন, ২০ একরসহ আরও ৬ দশমিক ১০ একর মিলিয়ে মোট ২৬ দশমিক ১০ একর জায়গার মূল্য বাবদ ১৬৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দকৃত ২৬ দশমিক ১০ একর জমির লিজ দলিল রাজউক থেকে তৈরি করে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হচ্ছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে।
তিনি সভাকে জানান, বরাদ্দকৃত জমির মধ্যে ১০ একর জমি রাজউকের মাস্টার প্লানে এই বাণিজ্য কেন্দ্রের জন্য সুনিদিষ্টভাবে উল্লেখ আছে। বরাদ্দ দেওয়া অবশিষ্ট ১৬ দশমিক ১০ একর জমি রাজউকের বর্তমান মাস্টারপ্লানে বাণিজ্যকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য সংরক্ষিত বলে উল্লেখ নেই। এ অবস্থায় প্রকল্পের কার্যক্রমের ওপর গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত এক সভায় রাজউকের মাস্টারপ্লানে যে ১০ একর জমি এই প্রকল্পের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে তা এখনই রেজিস্ট্রেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জমির বষয়ে ওই সভায় প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, দুই পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া ২০ একর এবং ৬ দশমিক ১০ একর জায়গায় মাঝখান দিয়ে রাজউকের মাস্টার প্লানে ৬০ ফুট রাস্তা নির্মাণের জন্য জায়গা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। রাস্তাটি এখনো নির্মাণ করা হয়নি। ওই রাস্তা নির্মাণ করা হলে সেখানে এক্সিবিশন সেন্টারের উপযোগী অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হবে না। তাই রাস্তার জন্য সংরক্ষিত জায়গা বাণিজ্য কেন্দ্রের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বরাদ্দর জন্য রাজউকে আবেদন করা হলেও অদ্যবধি বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরবর্তীতে আলোচনার পর এ সমস্যা সমাধানে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে সভায়। তবে জমির জটিলতার মধ্যেই প্রকল্পটির জন্য রাজউক থেকে আরও ১২ একর জমি পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ইপিবি’র মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জমির বিষয়ে জটিলতা আছে। তবে ইতোমধ্যেই আলাপ আলোচনা করা হচ্ছে। আশা করছি আগামী অক্টোবরের মধ্যে জমির রেজিস্ট্রেশন করে দেবে রাজউক। আর যেসব সমস্যা আছে সেগুলোরও সমাধান হবে।’
তিনি জানান, চীনের অনুদানের অর্থে স্থায়ী বাণিজ্য মেলা কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ প্রায় ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। এখন পুরোপুরি শেষ করতে কিছুটা সময় বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে এই সেন্টারটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সরকারি তহবিলের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফাইভ স্টার হোটেল তৈরি করা হবে। যেখানে বিদেশিরা এসে থাকতে পারবেন। সেই সঙ্গে তৈরি হবে কনভেনশন সেন্টার। এ জন্য ৬ একর জমি পাওয়া গেলেও মামলাসহ নানা জটিলতায় এখনো বুঝিয়ে দিতে পারেনি রাজউক।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিধি মেনে আগামী ২০২১ সালের বাণিজ্য মেলা পূর্বাচলেই আয়োজন করা হবে। যেহেতু নতুন সেন্টারটিতে পরিসর অনেক বড় সেহেতু স্বাস্থ্য বিধি মেনেই সেটি করা সম্ভব হবে।
পিআইসি সভায় প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এক্সিবিশন সেন্টারটির সব কাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশের নিকট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চীনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি কারিগরি এবং একটি বুঝে নেওয়া কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু যেহেতু প্রকল্পের সব কাজ আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে গত ৭ মে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া প্রকল্পটির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্মতি নিচ্ছে বণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বর্ধিত সময়ে প্রকল্পের অন্যান্য কাজের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ও পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির জন্য প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্বিতীয় সংশোধনের প্রস্তুতিও নেওয়া হবে। সভায় বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত এবং আশপাশের রাস্তাগুলো সংস্কারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিআরটিসির মাধ্যমে বিশেষ বাস সার্ভিস বা শাটল বাস সার্ভিস চালুর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।