নিয়োগের তথ্য নেই, কোটি টাকা বেতন যায় চসিকের ময়লা অপসারণ প্রকল্পে
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:২০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে ‘ডোর টু ডোর’ ময়লা-আবর্জনা অপসারণের নামে চার বছর ধরে অবাধ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আমলে ২০১৬ সালে এই কার্যক্রম শুরুর পর প্রতিমাসে শ্রমিকের সংখ্যা গাণিতিক হারে বেড়েছে। সর্বশেষ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত ২ হাজার ৬৫ জন শ্রমিকের জন্য মজুরি ছাড় হয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৭ টাকা। অথচ এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের কোনো তালিকা-নিয়োগপত্র বা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য চসিকের সচিবালয় শাখায় নেই!
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন গত ৬ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিচ্ছন্ন বিভাগের অধীন ‘ডোর টুর ডোর’ প্রকল্পের জন্য শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় তদন্তে একটি কমিটি করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের স্বচ্ছতা ছাড়াই এই প্রকল্পে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চসিকের পরিচ্ছন্ন ও হিসাব বিভাগ মিলে কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়াই এই খাতে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছে। এক্ষেত্রে কোনো বিধিবিধান মানা হয়নি। পরিচ্ছন্ন বিভাগ তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে, মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মৌখিক নির্দেশে তারা শ্রমিক সংগ্রহ করেছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে অনিয়মের ইঙ্গিত আসার পর ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
জানতে চাইলে চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিচ্ছন্ন বিভাগের ডোর টু ডোর প্রকল্পে বেশকিছু অনিয়মের তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে এসেছে। শ্রমিকদের কোনো ডাটাবেজ নেই। তাহলে হাজার-হাজার শ্রমিককে কিভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে? তালিকা ছাড়া সঠিক ব্যক্তি কর্মস্থলে হাজিরা দিচ্ছেন কি না, সেটাও তো বোঝা সম্ভব নয়। অথচ প্রতিমাসে দুই কোটি টাকার ওপর মজুরি আসছে।’
চসিক প্রশাসক বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা এই খাতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা আনার চেষ্টা করছি। পরিচ্ছন্ন বিভাগকে বলা হয়েছে, নিয়োগ দেওয়া দুই হাজার ৬৫ জন শ্রমিকের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মোবাইল নম্বর এবং ছবিসহ তালিকা করতে। সেই তালিকা সচিবালয়, পরিচ্ছন্ন বিভাগ ও হিসাব বিভাগে জমা থাকবে। তালিকা দেখে প্রতিদিন ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে মনিটরিং করা হবে। তখন ভুতুড়ে নিয়োগ হয়েছে কি না, সেটা বের হবে।’
গত ১৮ আগস্ট চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুফিদুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন প্রশাসক। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন— অতিরিক্ত প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর চৌধুরী ও উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম। গত ২২ সেপ্টেম্বর কমিটি প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৭৩০ জন। অস্থায়ী শ্রমিক আছেন ৮৯৮ জন। সর্বমোট ১ হাজার ৬২৮ জন শ্রমিক ‘ডোর টু ডোর’ বর্জ্য অপসারণ প্রকল্প শুরুর আগে থেকেই চসিকে কর্মরত আছেন। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের আগ্রহে নেওয়া ‘ডোর টু ডোর’ বর্জ্য অপসারণ প্রকল্পের জন্য ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট দুই হাজার অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় দুই হাজার শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন দিলেও চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ওই প্রকল্পে শ্রমিক দেখানো হয় দুই হাজার ১২ জন। আগস্টে এসে আরও ৫৩ জনকে নিয়োগের কথা বলা হয়। এ হিসাবে সর্বশেষ মোট ২ হাজার ৬৫ জন শ্রমিক এই প্রকল্পে নিয়োজিত থাকার কথা রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭১৭ জন শ্রমিক নিয়োগ করা হয় এই প্রকল্পে। ২০১৮ সালে আরও ৯৫ জন, ২০১৯ সালে ১৮৩ জন ও ২০২০ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৬৯ জন নিয়োগ করা হয়। এভাবে বাড়তে বাড়তে এই সংখ্যা ২ হাজার ৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে। গাণিতিক হারে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদনের বর্ণিত অনুশাসনকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রত্যেক বেতন বিলের নোটে উল্লেখ রয়েছে, আবেদনের ওপর মেয়র মহোদয়ের সদয় অনুমোদনক্রমে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। অথচ হিসাব বিভাগ কোনো ডক্যুমেন্টস ছাড়াই কিভাবে দুই কোটি টাকা ছাড় করেছেন, তা বোধগম্য নয়। পরিচ্ছন্ন বিভাগ নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু হিসাব বিভাগের উচিত ছিল বিল, বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া। বিধি মোতাবেক সচিবালয় ও পরিচ্ছন্ন বিভাগের কাছ থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন সংক্রান্ত নথি তলব করা। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
“পর্যালোচনায় আরও প্রতীয়মান হয়, শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া মেয়র (আ জ ম নাছির উদ্দীন) মহোদয়ের নির্দেশ অনুযায়ী মোতাবেক সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রতিমাসেই শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। প্রশ্ন জাগে, একজন শ্রমিক (আবেদনকারী) কিভাবে জানল যে চসিকে শ্রমিক লাগবে? আবেদনকারীর দরখাস্ত মেয়র মহোদয়ের সামনে কে উপস্থাপন করলেন? আবেদনের গায়ে মেয়র মহোদয় ‘ব্যবস্থা নিন’ লিখলেন, কিন্তু সেটা নথিতে উত্থাপিত হল না কেন?,”— উল্লেখ করা হয়েছে পর্যালোচনায়।
পরিচ্ছন্ন বিভাগের বরাতে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মৌখিক নির্দেশনায় পরিচ্ছন্ন বিভাগ শ্রমিক সংগ্রহ করেছে এবং তাদের দায়িত্ব বণ্টন করেছে।
এদিকে, বাস্তবে এত শ্রমিক এই প্রকল্পে কাজ করছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করে দেখার জন্য গত জুলাই মাসে কর্মরত ২ হাজার ১২ জনের তালিকা, পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও মোবাইল নম্বর পরিচ্ছন্ন বিভাগের কাছে চেয়েছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্যসম্বলিত কোনো তালিকা তারা দিতে পারেনি। এমনকি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলা হলেও ছক অনুযায়ী সেটিও গত চার বছরে করা হয়নি। এছাড়া দুই হাজার ৬৫ জন শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো তথ্যও চসিকের সচিবালয় শাখায় নেই। অথচ তাদের জন্য করপোরেশন থেকে ব্যয় হয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৭ টাকা। তদন্ত কমিটি বলেছে, ‘এটি অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবতা’।
কমিটির মতে, এই বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় প্রমাণ করে, চসিকের বিধিবিধান ও আইনকানুন পরিপালনে চসিকের পরিচ্ছন্ন ও হিসাব বিভাগ অতিমাত্রায় উদাসীন। সচিবালয় শাখাকে পাশ কাটিয়ে শ্রমিক বা যে কোনো কর্মচারি নিয়োগ বেআইনি।
শুরুতেই ওই প্রকল্পের জন্য শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ২০ জুলাই ও ২১ জুলাই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেয় চসিক। পরে আবার সেগুলো স্থগিত করা হয়। কেন ওই প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে এবং কেনই বা পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ব্যাখা জানতে পারেনি তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচটি শর্তের কথা বলা হলেও নিয়োগের সময় সেটা প্রতিপালন করা হয়নি। নিয়োগের সময় শ্রমিকদের কোনো দক্ষতা যাচাই করা হয়নি। পরিচ্ছন্ন বিভাগ তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে, মেয়র মহোদয় দক্ষতা যাচাই করেছেন। যেহেতু পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছ, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কাউন্সিলরের অদক্ষ আত্মীয়-স্বজন শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
তদন্তে বের হয়ে এসেছে, নগরীর ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হানুরুর রশীদের ব্যক্তিগত নথিতে বলা হয়েছে, তিনি দাখিল পাস। ওই পদের যোগ্যতা হচ্ছে এইচএসসি। তিনি সেবক পদের জন্য যে আবেদন করেছিলেন তাতে লেখা আছে, তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস। ২০১৩ সালে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন বলা হয়েছে। অথচ তিনি ১৯৯৯ সালের দাখিল পাসের সনদ দিয়েছেন। ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্ন সুপারভাইজার সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের লিখিত অভিযোগ থাকার পরও তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। এ ধরনের অসংখ্য অনিয়ম তদন্তের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটি ১১ দফা সুপারিশও উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশে বলা হয়েছে— স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত দুই হাজার শ্রমিকের বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগের এখতিয়ার চসিকের নেই। অবিলম্বে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারি করা দরকার। এছাড়া চসিকের সচিবালয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক শ্রমিকের ব্যক্তিগত নথি সংরক্ষণ করা ও ডাটাবেজ তৈরির কথা সুপারিশে বলা হয়েছে।
আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক ডোর টু ডোর তদন্ত কমিটি নিয়োগে অস্বচ্ছতা প্রতিবেদন বর্জ্য অপসারণ ময়লা অপসারণ প্রকল্প লুটপাটের অভিযোগ সাবেক মেয়র