‘৪ দিনে প্রকল্প অনুমোদন ইতিহাসে বিরল ঘটনা’
১৪ অক্টোবর ২০২০ ১০:১৩
করোনাকালের প্রথম দিকে যখন দেশের সব কিছুই অচল হয়ে পড়েছিল, দেশজুড়ে চলছিল লকডাউন, তখন এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় পরিকল্পনা কমিশনকে। মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রক্রিয়াকরণ করতে হয় করোনা সংক্রান্ত নতুন প্রকল্প। প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন। অল্প সময়ের মধ্যেই জীবন বাজি রেখে প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াকরণের অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ। সারাবাংলার পক্ষে কথোপকথনে অংশ নিয়েছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জোসনা জামান। সেই কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
সারাবাংলা: উন্নয়ন প্রকল্পে বিভিন্ন পণ্যের অতিরিক্ত দাম ধরার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসছে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে আপনার কোন দায় আছে কি?
আবুল কালাম আজাদ: যে সংস্থা থেকে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয় তাদের একটি কমিটি রয়েছে। সেই কমিটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) যাচাই-বাছাই করে। তারপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখানে পরিকল্পনা উইং প্রস্তাবগুলো যাচাই করে। তারপর সচিবের সভাপতিত্বে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও বিস্তারিত আলোচনা হয়। তারপরই আসে পরিকল্পনা কমিশনে। এখানে আসার আগে কয়েক দফা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকে। পরিকল্পনা কমিশনের আসার পর আমরা যেটা দেখি সেটি হচ্ছে, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে কি না। তারপর কিছু কিছু ব্যয়ও দেখা হয়। তবে হাজার হাজার ব্যয় প্রস্তাব থাকে ডিপিপিতে। সবগুলো যাচাই করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সময় নজর এরিয়ে যায়। তবে ডিপিপিতে যাই দাম ধরা থাকুক না কেন কেনাকাটা করা হয় ওপেন টেন্ডারে। সেক্ষেত্রে দরপত্রের দামই চূড়ান্ত ধরা হয়। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, কিছু ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মহল বা ব্যক্তি যুক্ত থাকে। যারা বেশি দাম ধরা থাকলে অনিয়মের সুযোগ পায়। আমরা চেষ্টা করি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ করার।
সারাবাংলা: কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিশ্বে প্রথম। এমন অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে করেছেন। চাকরি জীবনের প্রথম এমন অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আবুল কালাম আজাদ: প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্প প্রক্রিয়করণ করেছি। তখন ভয়ে কেউ অফিসে আসতো না। ভার্চুয়ালি বৈঠকের বিষয়টিও তখন প্রচলিত ছিল না। সেসময় কর্মকর্তাদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণের কাজ করিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি থাকলও সেদিকে আমরা কেউই নজর দিইনি। দায়িত্ব তখন অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সেখানে বসিয়েই ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। তারপর আবারও বৈঠক করেছি। তারপরই পাঠিয়েছি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য। এই কর্মকাণ্ড খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এভাবে একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ শেষ করেছি চারদিনে, আরেকটি সাতদিনে। এজন্য কর্মকর্তারা আলদা কোনো ইনসেনটিভও পাননি। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য কাজ করেছি।
সারাবাংলা: উন্নয়ন প্রকল্পের অহেতুক পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের কঠোরতা শিথিলের কথা বলা হয়। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাচ্ছি।
আবুল কালাম আজাদ: উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। তবে অতিরিক্ত পরামর্শক প্রস্তাব যে আসে না সেটি বলছি না। আমাদের দেশে এখনও দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে কারিগরি ক্ষেত্রে। এজন্য মাঝে-মধ্যে বিদেশ থেকে পরামর্শক নিতে হয়। সেক্ষেত্রে বেশি টাকা বরাদ্দ না রাখলে তারা আসতে চায় না। তাই অনেক সময় বেশি বরাদ্দ রাখা হয়। তবে কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় মনে হলে আমরা আলোচনার মাধ্যমে সেটি কমিয়ে দিই বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদও দেওয়া হয়। এগুলো কঠোরভাবে দেখা হয়।
সারাবাংলা:সম্প্রতি প্রাইমারি স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে বিদেশ সফর নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কি হলো?
আবুল কালাম আজাদ: আলোচনায় এসেছিল, খিচুরি রান্না শিখতে বিদেশ যাবেন কর্মকর্তারা। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। খিচুরি রান্না নয়, বরং ব্যবস্থাপনা কীভাবে হয় সেটি দেখতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ৫০০ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা বলেছি সেটি হবে না। কেননা বাচ্চাদের খাওয়ানোর সঙ্গে যুক্ত থাকে স্কুল ম্যানজিং কমিটি। তাই বিদেশ সফর দরকার হলে তাদেরই যেতে হবে। অবশেষে ১০ জনের করে তিনটি টিমে মোট ৩০ জনের বিদেশ সফরের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ভারতের কেরালা, দিল্লি ও কলকাতায় সফর করবেন। কেননা কেরালা অত্যন্ত সফলভাবে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আর শহরের অভিজ্ঞতা নিতে দিল্লির ব্যবস্থাপনা দেখতে হবে। পার্শ্ববর্তী কলকাতার অভিজ্ঞতাও আমাদের প্রয়োজন। কেননা তাদের ও আমাদের সামাজিক পরিবেশ প্রায় একই। দেশীয় প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যেসব এনজিও যুক্ত হবে অর্থাৎ যারা সাপ্লাইয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে প্রকল্পটির অন্যান্য ব্যয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সারাবাংলা: আপনার সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদক্ষেপ বা ঘটনার কথা জানতে চাই।
আবুল কালাম আজাদ: চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প এসেছিল। সেখানে বিভিন্ন পণ্যের দাম প্রস্তাবে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা পাওয়ায় ফেরত দিয়েছি। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। এরকম অনেকগুলো প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়েছি। যেগুলো আর সংশোধিত হয়ে ফেরত আসেনি। আমরা না ধরতে পারলে হয়তো ওই অবস্থাতেই অনুমোদন পেয়ে যেত।
সারাবাংলা: আপনার বৃক্ষরোপন কর্মসূচির কী অবস্থা?
আবুল কালাম আজাদ: বৃক্ষ রোপন করা আমার শখ। ইউএনও থাকতে যেসব উপজেলায় ছিলাম সেখানেও প্রচুর গাছ লাগিয়েছিলাম। আমার গ্রামের বাড়িতেও প্রচুর গাছপালা লাগানো হয়েছে। সেখানে ৭০০টি মেহগনি গাছও লাগিয়েছিলাম। আমরা ইচ্ছে ছিল চাকরি জীবনের শেষ ১০০ দিনে একশটি গাছ লাগাবো। সেই সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও যোগ হয়েছে। ফলে এবার বর্ষাকালেই পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে ১০০টি গাছের চারা লাগানোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলাম। এর বেশিরভাগই ফলদ বৃক্ষ। ইতোমধ্যেই গাছ লাগানোর কাজ শেষ করেছি।
সারাবাংলা: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
আবুল কালাম আজাদ: আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি আমার সরকারি চাকরির জীবন শেষ হচ্ছে। অবসর জীবনে বাবা-মায়ের নামে ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হবে। সেইসঙ্গে গ্রামে কৃষি খামার গড়ে তোলারও ইচ্ছে আছে।
সারাবাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ
আবুল কালাম আজাদ: সারাবাংলাকেও ধন্যবাদ
আবুল কালাম আজাদ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ খিচুরি রান্না চারদিন পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প অনুমোদন প্রাইমারি স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বিরল ঘটনা