যুবলীগ নেতা বললেন— ‘ইতারে মারি ফেলা’, এরপর কোপানো শুরু
১৭ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৩১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে নতুন ফিশারিঘাট এলাকায় বেড়া মার্কেটে বস্তিতে একজনকে কুপিয়ে খুনের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে আকতার নামে এক যুবলীগ নেতার সম্পৃক্ততার বিষয় নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। যুবলীগ নেতা আকতার ও তার অনুসারীসহ মোট সাত জনকে গ্রেফতারের পর পুলিশ জানিয়েছে, অনুসারীদের সঙ্গে বিরোধ মিমাংসার বৈঠকে ডেকে আকতার সরাসরি হত্যার নির্দেশ দেন। এরপরই মূলত তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত শুরু হয়। হত্যার পর একে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আকতার ও তার অনুসারীরা।
নগরীর বাকলিয়া থানায় কর্ণফুলী নদীসংলগ্ন এলাকায় সরকারি খাসজমিতে গড়ে ওঠা বিশাল বস্তির একটি কলোনির মালিক দাবিদার আকতার হোসেন (৪১), যিনি স্থানীয়ভাবে ‘কসাই আকতার’ নামে পরিচিত। গ্রেফতারের পর আকতার নিজেকে স্থানীয় বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। একই পদবি লেখা ব্যানারও মার্কেটে ঝুলছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
শনিবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত সাংবাদিকদের জানানো হয়। গত শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) রাতে আকতারের কলোনির ভাড়াটিয়া আবু তৈয়বকে (৪২) কুপিয়ে খুন করা হয়। এ ঘটনায় রাতেই আকতারসহ সাত জনকে গ্রেফতার করে বাকলিয়া থানা পুলিশ।
গ্রেফতার বাকি ছয়জন হলেন- আকতারের কলোনির ম্যানেজার মো. সাইফুদ্দিন (৪০), অনুসারী রায়হান উদ্দিন রানা (২৫), আশরাফুল ইসলাম (২৮), মো. সবুজ (৩৫), আবু তাহের কালু (২০) এবং আকতারের কলোনির ভাড়া সংগ্রহকারী হাসিনা (২৬)।
বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা আকতার ও তার অনুসারীদের সঙ্গে নিহত তৈয়বের তিন ধরনের বিরোধের তথ্য পেয়েছি। তৈয়ব ফিশিং ট্রলারে শ্রমিক সরবরাহ করে। এছাড়া নদীর তীরে নির্মিত কাঠের ট্রলার নদীতে ভাসানোর সময় যে শ্রমিক প্রয়োজন হয়, সেগুলো সরবরাহেও তার একক আধিপত্য ছিল। এই দুই সেক্টরে শ্রমিক সরবরাহের কাজ তার থেকে ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল আকতার। কিন্তু তৈয়বের প্রভাবের কারণে না পেরে আয়ের ভাগ বা চাঁদা দাবি শুরু করে। তৈয়ব চাঁদা দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। এছাড়া বেড়া মার্কেট এলাকায় তৈয়বের একটি দোকান আছে, সেখানে গিয়ে আকতারের ভাই মুন্না (পলাতক) প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করেছিল। সেটাও তৈয়ব দেননি।’
বাদির অভিযোগ ও তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খুনের বিবরণ দিয়ে ওসি বলেন, ‘নতুন ফিশারিঘাট এলাকায় ওয়ালটন শোরুমের সামনে তৈয়বকে আটকে আকতার বলেন- আবু তৈয়বকে মেরে ফেল। এরপর কোপানো শুরু হয়। লোহার রড, লোহার পাইপ দিয়ে বেধড়ক মারধরের পাশাপাশি কিরিচ-রামদা দিয়ে কোপানো হয়।’
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আকতারসহ মোট ৯ জন এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল আমরা তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে সাতজনকে আমরা গ্রেফতার করতে পেরেছি। পরিকল্পিত হত্যার পর আকতারসহ আসামিরা এই ঘটনাকে গণপিটুনি বলে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে পুলিশকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তবে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে হত্যায় জড়িত সাতজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।’
শুক্রবার রাতে যখন তৈয়বকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হচ্ছিল, সামনেই ছিলেন তার ছেলে শাহজাহান। তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে, ‘আমার আব্বার কাছে ট্যাক্স (চাঁদা) চেয়েছিল। আব্বা যখন দেয়নি, তখন তার সঙ্গে আকতারের লোকজনের হাতাহাতি হয়েছিল। আকতার আমার আব্বাকে মিমাংসা করার জন্য ডেকেছিল। আব্বাকে দেখেই আকতার বলে ওঠে- ওকে একেবারে মেরে ফেল। তখন সবাই মিলে আমার আব্বাকে মারতে শুরু করে। কোপ খেয়ে আমার আব্বা দৌঁড় দিয়ে রাস্তায় চলে আসে। সেখানেও আকতার এবং তার সন্ত্রাসীরা এসে আব্বাকে কোপাতে থাকে।’
বস্তিতে আধিপত্যের বিরোধে খুন, আটক ৬
নিহত তৈয়বের ভাতিজা মোহাম্মদ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, একটি সমবায় সমিতি বানিয়ে বেড়া মার্কেট বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন আকতার। সেখানে সমিতির অফিসে নিয়মিত সালিশ-মীমাংসা হয়। এছাড়া ওই অফিসে মাদক-জুয়ার আসরও বসে। তার অনুসারী কমপক্ষে ৪০ জন সন্ত্রাসী আছে। তৈয়বের বাড়ি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে শিকলবাহায়। শ্রমিক সরবরাহের কাজ পরিচালনা এবং শ্রমিকদের রাখার জন্য তিনি আকতারের কলোনিতে একটি ছোট কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন। আকতারের নির্দেশে তার ম্যানেজার সাইফুদ্দিন গিয়ে শ্রমিক সরবরাহের আয় থেকে অর্ধেক ভাগ দাবি করেন। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কথা কাটাাকটির জেরে আকতারের ভাই মুন্না, সাইফুদ্দিন ও হাসিনার সঙ্গে তৈয়বের ধাক্কাধাক্কি হয়। তৈয়ব তার কলোনির মালিক হিসেবে আকতারকে নালিশ করেন।’
‘আকতার শুক্রবার মাগরিবের নামাজের পর সমিতির অফিসে সালিশ বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য আমার চাচাকে (তৈয়ব) বলেন। সন্ধ্যা ৭টার পর তিনি সমিতির অফিসে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আকতার বলেন- ইতারে ল, ইতারে মারি ফেলা। সাথে সাথে কয়েকজন উনার শরীরে কোপ মারে। তখন তিনি দৌঁড়ে রাস্তায় চলে আসেন। আকতারের লোকজনও রাস্তায় আসে এবং কোপাতে থাকে। আকতার যুবলীগ করে। এই দাপটে সে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে সবার চোখের সামনে মেরে ফেলেছে’, বলেন হোসেন।
বাকলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ মঈন উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় দুই বছর আগে বেড়া মার্কেটের বস্তিতে আগুন লেগে কয়েক হাজার কাঁচা ঘর পুড়ে গিয়েছিল। এই জায়গাগুলো সরকারি খাসজমি হিসেবে চিহ্নিত। তবে জায়গাগুলো দখল করে একাধিক কলোনি বানিয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী। ভূমির দাবিদারদের সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চ আদালতে মামলা চলমান আছে। আগুনে পুড়ে যাবার মাসখানেকের মধ্যেই তারা আবারও সেখানে কাঁচাবসতি গড়ে তোলে। এই বস্তিকে ঘিরে দখল-বেদখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য- এসব নিয়ে নিয়মিত সংঘাত হয়। এই সংঘাতের বলি হয়েছেন আবু তৈয়ব।’
যুবলীগ নেতা আকতার হোসেনের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এই নামে কাউকে চিনি না।’