আমদানি বাণিজ্যে বিপর্যয়ের শঙ্কা, ২ দিনে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি
২১ অক্টোবর ২০২০ ২০:৩৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: শ্রমিক ধর্মঘটে নৌযান চলাচল এবং পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় দেশের আমদানি বাণিজ্যে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, বিদেশি জাহাজ অলস বসে থাকায় যোগ হচ্ছে ডেমারেজ। লাইটারেজ জাহাজগুলোর চলাচল বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন মালিকরা। এর চেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে— আমদানি করা পণ্য-কাঁচামাল আমদানিকারকের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এতে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বন্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দেওয়া প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দুই দিনের নৌযান ধর্মঘটে দেশের পণ্য পরিবহন ও জাহাজ খাতে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই ধর্মঘট অব্যাহত থাকলে আমদানি খাতে অচলাবস্থা নেমে আসবে।
আরও পড়ুন-
চতুর্থ দফায় সারাদেশে পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘট
নৌযান ধর্মঘট: চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গর-ঘাটে পণ্য খালাস বন্ধ
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নৌযান শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে ক্ষতি হচ্ছে বহুমুখী। তবে প্রাথমিকভাবে যে তিনটি খাতে ক্ষতি দৃশ্যমান সেগুলো হচ্ছে— বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বসে থাকা জাহাজগুলোকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার ডেমারেজ দিতে হবে। দেশের টাকা বিদেশি জাহাজ মালিকদের কাছে চলে যাবে। লাইটারেজ জাহাজগুলোর প্রতিদিনের অপারেশন কস্ট আছে, সেটা তো বসে থাকলেও দিতে হচ্ছে। কমপক্ষে প্রতিটির খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এরপর লাইটারেজ ও মাদার ভ্যাসেলে যেসব শিল্পের কাঁচামাল আটকে আছে, সেগুলো যদি সঠিক সময়ে না পৌঁছে, কারখানায় তো উৎপাদনই বন্ধ হয়ে যাবে।’
মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা চেম্বারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক একটা হিসাব করেছি— প্রতিদিনের আর্থিক ক্ষতি অন্তত ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা।’
এর আগে, ১১ দফা দাবিতে সোমবার (১৯ অক্টোবর) রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন। এরপর থেকে সারাদেশে পণ্য পরিবহনকারী নৌযান চলাচল বন্ধ আছে। তাদের দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ; ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস ও মালিক কর্তৃক খাদ্য ভাতা প্রদান; বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা; ২০১৬ সালের গেজেট অনুযায়ী বেতন দেওয়া; কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ বাড়িয়ে ১০ লাখ টাকা করা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসা বিদেশি মাদার ভ্যাসেল থেকে ১১ লাখ ৯০ হাজার ৭৩৮ মেট্রিক টন আমদানি পণ্য খালাসের পর সেই পণ্য নিয়ে ৮৭৪টি লাইটারেজ জাহাজ দেশের ৩৮টি ঘাটে বসে আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৫৪টি বড় জাহাজ প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন পণ্য নিয়ে বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে পণ্য খালাস এবং পরিবহন বন্ধ থাকায় অলস বসে আছে এসব জাহাজ।
লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন (ডব্লিউটিসি) সেল সূত্রে জানা গেছে, গম, স্ক্র্যাপ, রড, সয়াবিন, ভুট্টা ও পাথর নিয়ে কর্ণফুলী নদীসহ আশপাশের বিভিন্ন ঘাটে এক লাখ ১৯ হাজার ২০৮ মেট্রিন টন পণ্য নিয়ে ৮২টি লাইটার জাহাজ বসে আছে। গম, কাদামাটি, ইউরিয়া, কয়লা ও ভুট্টা নিয়ে নয়াপাড়া ঘাটে ৬৫টি; ইউরিয়া-গম নিয়ে নগরবাড়ি ঘাটে ৩২টি; গম, কাদামাটি, ডাল, এইচআর কয়েল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে ১১৭টি; পাথর, কয়লা, গম নিয়ে মিরপুর ঘাটে ৫৮টি এবং গম-ভুট্টা নিয়ে পূর্বগ্রামে ৫৯টি লাইটারেজ জাহাজ অলস বসে আছে।
মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) ডব্লিউটিসি থেকে সিরিয়ালের অপেক্ষায় ছিল ৩৭৬টি লাইটারেজ জাহাজ। এগুলোসহ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে থাকা প্রায় ২ হাজার লাইটারেজ জাহাজ অলস বসে আছে।
ডব্লিউটিসি’র নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইসের সংক্রমণের পর একধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এই সেক্টর তিন মাস পার করেছে। আমাদের কমপক্ষে ৮০০ জাহাজ তিন মাস ধরে অলস বসেছিল। ২-৪টা বুকিং হলেও অধিকাংশ জাহাজই পণ্য পরিবহন করতে পারেনি। এই ক্ষতিটা যখন আমরা আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছিলাম, তখন ধর্মঘটের মধ্যে পড়ে আরেকটা প্রত্যক্ষ ক্ষতির মুখে পড়েছে এই সেক্টরটা। মাদার ভ্যাসেলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, লাইটারেজেরও ক্ষতি হচ্ছে। কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ ক্ষতি হচ্ছে দিনে। এর মধ্যে অর্ধেক লাইটারেজের ক্ষতি, বাকি অর্ধেক মাদার ভ্যাসেলের।’
চট্টগ্রাম ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী শফিক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লাইটারেজ জাহাজগুলোর তো একটা পরিচালন ব্যয় আছে। দৈনিক আমাদের ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়। লবণাক্ত পানির মধ্যে জাহাজগুলো যে অলস বসে আছে, সেটারও একটা ক্ষতি আছে। আমাদের হিসেবে, দিনে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার ক্ষতি শুধু আমাদের হচ্ছে।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি একটা জাহাজ যখন চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়, এগুলোর শিডিউল আগেই নির্ধারিত থাকে। ট্রিপও নির্ধারিত থাকে। ধমর্ঘটের কারণে বিদেশি জাহাজ বসে আছে, তার ট্রিপটা তো বাতিল হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই উনাকে আমি ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার হারে আমাদের এই ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে। এতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি এমনভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে যে ভবিষ্যতে বিদেশি জাহাজ মালিকরা বাংলাদেশে জাহাজ পাঠাবেন কি না, সেটা নিয়ে আশঙ্কা আছে। এই সমস্যা বারবার হচ্ছে। এর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘যে ডেমারেজ বিদেশি জাহাজ মালিকদের দিতে হচ্ছে, শিপিং এজেন্টরা সেগুলো আমদানিকারকের কাছ থেকে উসুল করবেন। আমদানিকারকের প্রোডাকশন কস্ট বেড়ে যাবে। উনি ক্ষতি পোষাতে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়াবেন। সার্বিকভাবে বাজারে প্রভাব পড়বে।’
ডব্লিউটিসি’র নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জরুরি সেক্টর বিবেচনায় পণ্য পরিবহন খাতে শ্রমিক ধর্মঘট পালনের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। এছাড়া সরকারি গেজেট অনুযায়ী বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলনের সুযোগ নেই। সার্বিক বিষয়ে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) বিকেল ৩টায় চট্টগ্রাম বন্দর ভবনে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। আশা করি সেখানে বিষয়টি সুরাহা হবে।’
ছবি: শ্যামল নন্দী