শুধু চালকদের দোষারোপ নয়, আইন হাতে তুলে নেবেন না: প্রধানমন্ত্রী
২২ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৩৭
ঢাকা: রাস্তা পারাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা পথচারী আমরা শুধু ড্রাইভারদের দোষ দেই। শুধু ড্রাইভারদের দোষ দিলে হবে না। যদি ড্রাইভারের দোষ হয়, আইন আছে। আইন তার ব্যবস্থা নেবে। কেউ আপনারা নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না, এটা আমার অনুরোধ থাকল।
বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) সকালে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২০ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালে বনানীতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি মিলনায়তনে যুক্ত হয়ে জনসাধারণের প্রতি এ অনুরোধ জানান। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
মহাসড়কের পাশে গালি চালকদের জন্য বিশ্রামাগার গড়ে তোলার পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারণ আমরা চাচ্ছি যারা গাড়ি চালায়, আমরা অনেক সময় তাদের ভালো-মন্দের দিকে চিন্তা করি না। একটা মানুষ কতক্ষণ গাড়ি চালাতে পারে। কারণ আমার দেশে এলে আসলে নিজেরা তো খুব গাড়ি চালায়, সবাই তো ড্রাইভার রাখেন। আর ড্রাইভার তারা অমানুষিক পরিশ্রম করে। কত ঘণ্টা একটানা একটা মানুষ গাড়ি চালাতে পারে বা কতটুকু তার বিশ্রাম প্রয়োজন সেটি কিন্তু কখনো আমাদের হিসাবেই নেয় না।’
তিনি বলেন, ‘এটা হলো দুর্ভাগ্যের বিষয়টা। এ বিষয়টায় সবাইকে একটু সচেতন থাকা দরকার। সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা মহাসড়কগুলোর বিভিন্ন জায়গায় বিশ্রামাগার নির্মাণ করছি। পর্যায়ক্রমে সারাদেশেই চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণ করব।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক ন্যাশনাল রোড সেফটি অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৭-২০ প্রণয়ন করেছি। কাজেই এটাকে আরও বাড়াতে হবে, এই প্ল্যানটা আরও যুগোপযোগী করতে হবে। আমি মনে করি, ২০২১ থেকে পরবর্তী কী হবে, কারণ আমরা যেহেতু অনেক নতুন রাস্তাঘাট, পুল ব্রিজ করে যাচ্ছি। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে অ্যাকশন প্ল্যানটাকে নতুনভাবে আরেকটা প্রণয়ন করার প্রয়োজন আছে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলা, এটি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি বারবার বলেছি, এখনো বলি, স্কুল জীবন থেকেই ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে ট্রাফিক আইনটা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া, সচেতন করা, প্রত্যেকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অফিস আলাদত সব জায়গায় ওই ট্রাফিক রুলের পোস্টার লাগিয়ে রাখা এবং সবাই যেন এটি সবসময় দেখে এবং তাদের নজরদারিতে থাকে এবং তারা যেন সেভাবে সচেতন হয়, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা প্রাইভেটে গাড়ি চালান, ড্রাইভার রাখেন তাদেরকে অনুরোধ করব, আপনাদের ড্রাইভার কতক্ষণ গাড়ি চালাতে পারে একটানা, ড্রাইভার বিশ্রাম নিল কিনা? ড্রাইভার খাবার খেয়েছে কি না? ড্রাইভার কখনো ঝিমিয়ে আছে কি না, সেই বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখবেন। কারণ যে আপনাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার ভালো-মন্দটা তো দেখা উচিত। তা ছাড়া আপনারা নেমে গেলেন দাওয়াত খেতে আর ড্রাইভার বসেই থাকল? সে গাড়ি ছেড়ে যেতেও পারছে না, তার খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, ওভাবেই বসে আছে। তাদের জন্য আগে খাবারের ব্যবস্থা করে রাখুন। কারণ সে তো আপনাকে নিয়েই চালাচ্ছে। কাজেই তার ভালো-মন্দটা দেখা উচিত। সেটি নিশ্চয় সবাই একটু দেখবেন। আমি সেই অনুরোধ করব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা গাড়ি চালাচ্ছে তারা মাদক সেবন করে কি না? তাদের ড্র্যাগ পরীক্ষা করা দরকার এবং মাদক সেবন করে কি না, সেটা পরীক্ষা নেয়া দরকার। প্রত্যেকটা ড্রাইভারের এই পরীক্ষা একান্তভাবে অপরিহার্য। সেটাও আপনাদের করতে হবে।’
চালকদের ওভারটেক প্রবণতা বন্ধ করা পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘যারা পথচারী আমরা শুধু ড্রাইভারদের কথা বলি, আর ড্রাইভারদের দোষ দেই। শুধু এই ড্রাইভারদের দোষ দিলে হবে না। আমাদের পথচারীদেরও সচেতন থাকতে হবে। সেখানে সচেতনতার খুবই অভাব। আমরা মুখে খুব বলে-টলে যাই কিন্তু কাজের বেলায় আমরা কি দেখি? পাশেই ফুটওভার ব্রীজ, রাস্তার মধ্যে কিন্তু হেঁটে যাচ্ছে। একটা গাড়ি আসছে, একটু হাত দেখিয়েই অমনই হাঁটা দিল। এটি একটা যান্ত্রিক ব্যাপার। ব্রেক কষলেও সেটা থামতে কিন্তু কিছু সময় লাগে। হাত দেখালেই থেমে যেতে পাওে না। সেই ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করতে হবে। সেটা প্রচারও করতে হবে, বলতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে।’
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় বাচ্চা নিয়ে মা ফ্লাইওভার বাদ দিয়ে রাস্তার মধ্যে দৌড় দিল। বাচ্চা হাত থেকে ছুটে গেল, গাড়ির নিচে পরে মারা গেল? দোষ কার? ড্রাইভারের ? কেন ড্রাইভারকে দোষ দেব! দোষ তো ওই মা’র। যে বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছে।
এ রকম কোনো এক পিতার কথার উদাহরণ দিয়ে বলেন, কাকে দোষ দেবো! তখন কিন্তু সরকারের দোষ। আন্দোলন হবে সরকারের বিরুদ্ধে? সরকারের পদত্যাগ চাইবে কিন্তু দোষটা কার সেটা দেখবে না। কাজেই এইসব বিষয়ে যে নাগরিক সচেতনতা আমাদেরদেশে খুব বেশি প্রয়োজন। খুব বেশি প্রয়োজন বলে মনে করি।
কাজেই যত্রতত্র যেখানে সেখানে রাস্তা পারাপার হওয়া এটা বন্ধ করতে হবে এবং ট্রাফিক রুল সবাইকে মেনে চলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
দুর্ঘটনা ঘটলে চালকদের মারধরের না করারও আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সে জন্য আমি বারবার জনগণকে সচেতন করেছি। এখন আবারও অনুরোধ করবো, কোন অ্যাক্সিডেন্ট হলে কেউ ড্রাইভারের গায়ে হাত দেবেন না। কেউ গাড়ি আক্রমণ করবেন না। বরং যে পড়ে গেছে তাকে রক্ষা করার জন্য, এখন আমাদের কিন্তু পুলিশের সার্ভিস খুবই ভালো যে কোন সময় ৯৯৯ ফোন করলে তারা পৌঁছে যাচ্ছে। যে কোন সময় খবর দিলে তারা এসে যাচ্ছে। কেউ সেখানে হাত না দিয়ে তাদের ডাকেন। উদ্ধার করুক। হাসপাতালে নিয়ে যাক, চিকিৎসার ব্যবস্থা হোক। আর তারপরে বিচার করেন কী কারণে দুর্ঘটনা হলো। যদি ড্রাইভারের দোষ হয়, আইন আছে। আইন তার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আইন কেউ হাতে তুলে নেবেন না এবং এই আইন হাতে তুলে নেবার কারণে অনেক মানুষ কিন্তু মারা যায়। কারণ ড্রাইভার সাহস পায় না, গাড়িটা থামায়ে ওই লোকটাকে সাহায্য করতে। তার ভয় হয়, তার যে গাড়ির ধাক্কায় পড়ে গেছে, সে যদি থামাতে যায় বা তাকে যদি সাহায্যও করতে যায় তাহলে সে পাবলিকের হাতে মাইর খাবে। এই মানসিকতাটা পরিহার করতে হবে। এই ব্যাপারে আমি বলবো, আমাদের যারা নিরাপদ সড়ক নিয়ে আন্দোলন করেন, তাদেরও অনুরোধ করবো, এটি একটু ব্যাপক প্রচার করেন আপনারা।’
সর্বক্ষণ ওই গাড়ির দোষ, ড্রাইভারের দোষ, অমুক দোষ সেটা না দেখে কার দোষে অ্যাক্সিডেন্ট, সেই জিনিসটাকে দেখতে হবে। সেটি বিবেচনা করতে হবে। আর বিচারের জন্য তো আইন আছে? আদালত আছে সেখানে বিচার আছে কাজেই কেউ আপনারা নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। এটা আমার অনুরোধ থাকল বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
রাস্তা পারাপারের সময় সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জেব্রা ক্রসিংয়ের বাইরে যদি কেউ অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যায়, সে দায়িত্ব কেউ নেবে না। যে রাস্তায় যাবে, দায়িত্বটা তার। সেটাও মাথায় রাখতে হবে এবং এটার একটা ব্যাপক প্রচার দরকার।’
আর যে সমস্ত জায়গায় স্কুল আছে-কলেজ বা বেশি গ্যাদারিং বেশি- সেই সব জায়গা গুলিতে ভলান্টিয়ার রাখার পাশাপাশি প্রত্যেকটা স্কুলকে নিজের দায়িত্ব নিয়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের রাস্তা পারাপারের বিষয়টি দেখভাল করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
ট্রাফিক আইন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। কাজেই আমি সবাইকে এটাই বলবো, এখন তো করোনাভাইরাস, এ করোনাভাইরাসে সবাইকে কিন্তু স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম মেনে চলতে হবে।
আর প্রত্যেকটা রাস্তায় স্পিড লিমিট কত সেটা থাকতে হবে। এখন বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং সব জায়গায় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সেভাবে ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে। কেউ যদি স্পিড ক্রস করে সঙ্গে সঙ্গে তার ফাইন হবে। কেউ যেন না করতে পারে, সেইভাবে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। নতুন যত সড়ক হবে সেইভাবে সেই সব জায়গায় সেই সিস্টেমটা থাকতে হবে। দরকার হলে লেজার বিন দিয়ে গাড়ি আটকে দিয়ে ফাইন নিতে হবে। কাজেই সেই ব্যবস্থাটি আমাদের হাতে নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি অনেকক্ষণ কথা বললাম। কারণ এই দুর্ঘটনায় যখন মানুষ মারা যায়, বা কেউ পঙ্গু হয়ে যায়, এটা সত্যি খুব দুঃখজনক। কাজেই যারা চালক বা যারা পথচারী বা সাধারণ জনগণ, দুর্ঘটনার দায়-দায়িত্ব কিন্তু সবারই আছে। সেটি মনে রেখে সবাই নিজেরা সুরক্ষিত করতে সচেষ্ট হবেন। আবার করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখতে সচেতন হবেন। সেটিই আমরা চাই।’