৩শ বিঘা জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই দখলের চেষ্টা— অভিযোগ ৫ হাজার পরিবারের
২৬ অক্টোবর ২০২০ ০৮:৩১
কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় তিনশ বিঘা জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই দখলের প্রচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব জমির মালিকানা প্রান্তিক পর্যায়ের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের। তাদের অভিযোগ, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে এবং বিভিন্ন দফতরে ঘুরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও তারা প্রতিকার পাচ্ছেন না। নিজেদের কৃষি জমি ও বসতভিটা রক্ষায় দারিদ্র্যপীড়িত এই জনগোষ্ঠী শেষমেষ প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছেন।
জানা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তড়িঘড়ি করে বাগভান্ডার থেকে সোনাহাট স্থলবন্দরগামী রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলেও রাস্তার জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি, অর্থাৎ জমির মালিকদের কোনো ধরনের টাকা দেওয়া হয়নি। সে অনুযায়ী ওই রাস্তার জমি ব্যক্তি মালিকানায় এসএ রেকর্ড হিসেবে চূড়ান্ত হয়। জমির মালিকরাও তাদের নামেই ওই জমি নামজারি করে ভূমি আইন মেনে যাবতীয় কর পরিশোধ করে আসছেন।
পরে মাঠ জরিপের সময় জনস্বার্থে রাস্তাটি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড হয়। তবে রাস্তার দুই পাশের জমি আগের মালিকদের নামেই রেকর্ড হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ করেই এমন একটি প্রচারণা শুরু হয় যে রাস্তার দুই পাশের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি জমির সবই সামরিক ভূ-সম্পত্তি নর্দান সার্কেল বগুড়া সেনানিবাসের মালিকানাধীন। অভিযোগ ওঠে, ভূরুঙ্গামারী ভূমি অফিসের সাবেক কানুনগো ও বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম এসব জায়গাজমির নতুন কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছেন, যাতে এসব জমিকে সামরিক ভূ-সম্পত্তি নর্দান সার্কেল বগুড়া সেনানিবাসের মালিকানাধীন দেখানো হয়েছে।
এদিকে, ৩২ নম্বর বাগভান্ডার ও ৪৪ নম্বর দেওয়ানের খামার মৌজার তসদিক চলাকালে সামরিক ভূ-সম্পত্তি নর্দান সার্কেল বগুড়ার পক্ষ থেকে ‘ডিসপিউট কেস’ করা হয়। ওই সময় ভূরুঙ্গামারীর সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার তাদের সঠিক কাগজপত্র না থাকায় ডিসপিউট কেসগুলো নামঞ্জুর করে ব্যক্তি মালিকদের নামে জায়গার মালিকানার রেকর্ড বহাল রাখেন এবং সে অনুযায়ী ডিপি খতিয়ান প্রস্তুত হয়।
পরে ৪৫ নম্বর গছিডাঙ্গা, ৪৬ নম্বর পাইকেরছড়া ও ৬৪ নম্বর বানুরকুটি তিনটি মৌজায় সামরিক ভূ-সম্পত্তি দফতর বগুড়া ৩০ ধারায় আপত্তি মামলা দায়ের করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬ নম্বর পাইকেরছড়া মৌজা ও ৪৫ নম্বর গছিডাঙ্গা মৌজার আপত্তি মামলাগুলোর শুনানি নেন সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার। বগুড়া সামরিক ভূ-সম্পত্তি প্রশাসক নর্দার্ন সাকেল তাদের দায়ের করা মামলার পক্ষে কোনো নথি উপস্থাপন করতে না পারায় তাদের মামলা নামঞ্জুর করে ওই জায়গাগুলোর ব্যক্তি মালিকানার রেকর্ড বহাল রাখা হয় শুনানি শেষে।
পরে বগুড়া সামরিক ভূ-সম্পত্তি প্রশাসক নর্দার্ন সার্কেল ভূরুঙ্গামারী সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের কাছে এক বছর সময় প্রার্থনা করে। তারা বলছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সেনানিবাসের অফিস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে এবং ওই সময় সারাদেশ মিলে শুধু ঢাকয় একটিমাত্র অফিস থাকায় অধিগ্রহণ করা জমির এলএ, নকশা, দাগসূচি, হস্তান্তর/গ্রহণ সনদ এবং গেজেটের কপি সম্পূর্ণরূপে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে ঢাকার মিলিটারি এস্টেট অফিসের রেকর্ড রুম তল্লাশি করে মিলিটারি এস্টেটস অফিসার ইস্ট পাকিস্তান সার্কেল ঢাকার সই করা মিলিটারি ল্যান্ড রেজিস্ট্রার (এমএলআর) পাওয়া গেছে। নর্দার্ন সার্কেলের দাবি, এই রেজিস্ট্রার অনুযায়ী বিবদমান জমি তাদের অনুকূলে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল।
এসময় ভূরুঙ্গামারী সেটেলমেন্ট অফিসার গত ৮ জুলাই ৫০(২) স্মারকে রংপুর জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারকে বিষয়টি অবগত করেন। পরে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের উপপরিচালক গত ১২ আগস্ট ৫১৮ নম্বর স্মারকে সময় না দিয়ে নালিশি পাঁচটি মৌজার আপত্তি মামলাগুলো বিধি অনুযায়ী নিষ্পত্তির আদেশ দেন। সে অনুযায়ী রংপুর সেটেলমেন্ট অফিসার ভূরুঙ্গামারী সেটেলমেন্ট অফিসারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেন।
এসব বিষয়ে স্বত্ব দখলীয় ভূমি মালিক কমিটির আহ্বায়ক তাইফুর রহমান মুকুল সারাবাংলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত যত ধরনের কাগজপত্র আছে, সবই আমাদের নামে। জায়গাগুলো নিয়ে যতগুলো মামলা সেটেলমেন্ট অফিসারের কাছে গেছে, সবগুলোতেই আমাদের পক্ষেই রেকর্ড থেকে গেছে। তারপরও আমাদের জায়গা দখল করে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা সব জায়গায় গিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা নিরীহ এলাকাবাসী প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কারণ এই জায়গাটুকু ছাড়া আমাদের আর কিছুই নাই।
এ বিষয়ে সামরিক ভূ-সম্পত্তি নর্দান সার্কেল বগুড়া কিংবা কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে ভূরুঙ্গামারী সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার মো. লতিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, পাঁচটি মৌজার মধ্যে আগের ডিসপিউট (তসদিক) ও বর্তমান ৩০ ধারার আপত্তি মামলার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি। চলতি অক্টোবরের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখ শুনানি রয়েছে। যারা বৈধ কাগজপত্র উপস্থাপন করবেন, রায় তাদের পক্ষে যাবে।
এ বিষয়ে কথা হলে ভূরুঙ্গামারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুই পক্ষই ওই জমির মালিকানা দাবি করছে। অনেক সময় এরকম হয়। তবে আমরা কাগজপত্র দেখব। কাগজপত্রের বৈধতার ভিত্তিতে প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হবে।
কুড়িগ্রাম জমি অধিগ্রহণ জমি দখল পাঁচ হাজার পরিবার বগুড়া সেনানিবাস মিলিটারি ল্যান্ড রেজিস্টার সামরিক ভূ সম্পত্তি নর্দান সার্কেল