হাজী সেলিমের ছেলের ‘টর্চার সেলে’ হাড়-দড়ি-দূরবীন-হাতকড়া
২৭ অক্টোবর ২০২০ ০০:৪৩
ঢাকা: ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সন্ধান মিলেছে আগেই। পাওয়া গেছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র, বিদেশি মদ। এখানেই শেষ নয়, ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বাসায় ‘টর্চার সেল’ খুঁজে পেয়েছে র্যাব। ইরফান নিজে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেই জনপ্রতিনিধির বাড়িতেই গড়ে তোলা সেই টর্চার সেলেই মিলেছে হাড়গোড়, দড়ি, দূরবীন, হাতকড়ার মতো সব সরঞ্জাম।
সোমবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে চকবাজার এলাকায় ইরফান সেলিমের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সেই অভিযান। এরপর ওই বাড়ির নানা ‘আয়োজন’ নিয়ে একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন-
- হাজী সেলিমের বাড়ির পাশে আরও একটি টর্চার সেল
- হাজী সেলিমের ছেলের নামে মামলায় প্রতিবেদন ৩০ নভেম্বর
- হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান ও দেহরক্ষীর ১ বছরের কারাদণ্ড
- নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর: হাজী সেলিমের গাড়িচালক রিমান্ডে
- নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর: এমপি হাজি সেলিমের ছেলে গ্রেফতার
- ইরফান সেলিমের বাসায় বিপুল পরিমাণ ওয়াকিটকি-ইলেকট্রনিক ডিভাইস
অভিযানে অংশ নেওয়া র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, আশিক টাওয়ার নামে হাজী সেলিমের ওই বাড়ির পাশের বাড়ির ১৬ তলা ভবনের ছাদের ওপরের একটি কক্ষকে ইরফান সেলিম ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানেই পাওয়া গেছে হাড়। তবে সেই হাড় মানুষের কি না— সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি র্যাব কর্মকর্তারা। সেই হাড় কী কাজে ব্যবহার করা হতো, সে বিষয়েও এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছেন না তারা।
র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই ‘টর্চার সেলে’ হাড় ছাড়াও সোনালি রঙের দূরবীন, হকি স্টিক, লাঠি, রশি, ইয়াবা খাওয়ার কয়েলসহ নানা ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। আরও পাওয়া গেছে একটি ওয়্যারলেস কন্ট্রোল ট্রানজিস্টর, হিট জেনারেটিং ট্রান্সমিটার, ছুরি, বিভিন্ন ধরনের দড়ি ও গামছা, ওয়াকিটকি, স্ক্রু ড্রাইভারের একটি বাক্স, স্যাভলন ও ভিডিও রেকর্ডার। দড়ি ও গামছা সম্ভবত ভিকটিমের হাত-পা-চোখ বাঁধার জন্য ব্যবহার করা হতো বলে মনে করছেন র্যাব সদস্যরা। তারা বলছেন, ভিডিও রেকর্ডার দিয়ে সম্ভবত ধারণ করে রাখা হতো নির্যাতনের সময়কার ভিডিও।
পরে র্যাবের মুখপাত্র এবং আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ইরফান সেলিমের একটি টর্চার সেল রয়েছে— এমন তথ্য আমাদের কাছে ছিল। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান চালিয়েছি আমরা। সেখান থেকে হাতকড়া, দড়ি, চাকুসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। হাড়ও পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ফরেনসিক রিপোর্ট ছাড়া এখনই কিছু বলতে পারছি না।
অভিযানে সরেজমিনের গিয়ে দেখা গেছে, চকবাজারের ওই বাড়ির চতুর্থ ও পঞ্চম তলাটি ডুপ্লেক্স হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্থ তলার উত্তর কোনার রুমে থাকতেন ইরফান সেলিম। তার রুমের তোশকের নিচে ম্যাগজিন ভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল পাওয়া যায়। এছাড়া পঞ্চম তলায় পূর্ব দিকের কোনার রুমে পাঁচটি ওয়্যারল্যাস ভিপিএস সিস্টেম (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার) ও ৪০টি ওয়াকিটকি সেট, একটি হাতকড়া, একটি বন্দুক, বিদেশি মদের বোতল ও বিয়ার পাওয়া গেছে। এসব সরঞ্জাম ও অস্ত্রের যেটি যে অবস্থায় ছিল, ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য সেগুলো ঠিক সেভাবেই রেখে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম।
এর আগে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চকবাজারের ২৬ নম্বর দেবীদাস ঘাট লেনের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব। অভিযানের শুরুতেই হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয় র্যাব। পরে তার বাড়ি থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার হওয়ায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ইরফান ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন।
এর আগে, রোববার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় হাজী সেলিমের গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় সোমবার ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন ওয়াসিফ। মামলায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম, প্রোটকল অফিসার এ বি সিদ্দিক দিপু, মোহাম্মদ জাহিদ ও মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও তিন জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ রোববার রাত পৌনে ৮টার দিকে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে কলাবাগানের দিকে যাচ্ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) পেছন থেকে তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়।
ওয়াসিফ ও তার স্ত্রী ধাক্কা সামলে মোটরসাইকেল থেকে নামেন। এসময় গাড়ি থেকে জাহিদ, দিপু ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুই-তিন জন অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে নেমে আসেন এবং মারধর শুরু করে। তারা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ ও তার স্ত্রীকে ‘উঠিয়ে নেওয়া ও হত্যা’র হুমকি দেয় বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
পরে ঘটনাস্থলে লোকজন জড়ো হলে সংসদ সদস্যের গাড়ি ফেলে মারধরকারীরা পালিয়ে যান। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে গাড়ি ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তার মোটরসাইকেল ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায়।
ইরফান সেলিম ছুরি টর্চার সেল দড়ি-গামছা র্যাবের অভিযান হকি স্টিক হাজী সেলিম হাড়