Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘সময় এসেছে বাংলাদেশের জিও স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করার’


২৯ অক্টোবর ২০২০ ১৮:১৩

ঢাকা: অনেক আগে কূটনীতি ছিল রাজা-রানির জন্য। তবে এখনকার কূটনীতি জনগণের জন্য। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত, সামরিক, সামুদ্রিক সম্পদ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এখন মিডল পাওয়ারের দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। সময় এসছে বাংলাদেশের একটা জিও স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করার, যা সকলে মিলে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ার ফেলো মো. শহীদুল হক সারাবাংলা ডটনেটের বিশেষ আয়োজন সারাবাংলা ফোকাসে এমন মন্তব্য করেন। সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানীর উপস্থাপনায় সারাবাংলা ফোকাসের ৬৫তম পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি’। বুধবার (২৮ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত এই পর্বের আলোচনায় সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

একটা দেশের জন্য কৌশলগত নীতি নির্ধারণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?- এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ার ফেলো মো. শহীদুল হক বলেন, ‘জিও পলিটিক্স এবং জিও ইকনোমিকসের সমন্বয়ে একটা দেশের জিও স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা হয়। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বলে যে, তাদের একটা গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি (বড় কৌশল) আছে। অনেকেই বলে যে ট্রাম্পের কোনো গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি ছিল না। যে কারণে আন্তর্জাতিক ইনফ্লুয়েন্স সে হারিয়েছে।’

বাংলাদেশের কৌশল সম্পর্কে মো. শহীদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ অবস্থানগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই অবস্থান শুধু বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিকই নয়, বাংলাদেশ অন্যতম একটি বড় ব-দ্বীপ অঞ্চল। যে কারণে বাংলাদেশের আরও কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্ম থেকে ক্রমশ তার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে সেগুলোর মধ্যে প্রথমত, শিফটিং ইকনোমি এবং নিউ অ্যালায়েন্সেস। আমাদের পুরো এশিয়াতে অবস্থান আছে, বিশ্বে একটা অবস্থান আছে, আবার আমাদের রিজিওনেও আমাদের একটা অবস্থান আছে। দ্বিতীয়ত, বঙ্গেপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থান হওয়াতে পরিবেশ বা জলবায়ু সংক্রান্ত প্রচুর ঝুঁকিও আমাদের রয়েছে। তৃতীয়ত, টেকনোলজিকেল অ্যাডভান্সেস। যেটা রিবেন্সিং দ্য পাওয়ার স্ট্রাকচার, বোথ ইকনোমিক্যালি অ্যান্ড পলিটিক্যালি- ওই জায়গাতে আমরা কেমন আছি। এগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। সোস্যাইটিকে বাদ দিলে কিছুই হয় না। সেজন্য রাইজ অব পপুলেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিজমকে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। এটা নতুন ডায়নামিকস। সর্বশেষ বে অব বেঙ্গলের একটা জিও ইকনোমিকস এবং জিও পলিটিকস দাঁড়িয়েছে।’

‘প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭২ সালে আমরা যে ধরনের ডিপ্লোমেসি করতাম, যেভাবে আমরা বাংলাদেশকে বাইরে তুলে ধরতাম, যেভাবে আমরা নেগোশিয়েট করতাম, এখনও কী আমরা ওইভাবে নেগোশিয়েট করব? ইজ দ্যাট সামথিং অ্যান অপশন নাকি আমরা এটাকে রিভিজিট করতে হবে, রিভাইটালাইজ করতে হবে?’ এমন প্রশ্ন তুলে মো. শহীদুল হক বলেন, ‘আমি মনে করি যে আমাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময় এসেছে বাংলাদেশের একটা জিও স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করার, যা সকলে মিলে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।’

কেন আমাদের এখন জিও স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করতে হবে?- তার ব্যাখ্যায় সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘কেননা, আমরা এখন আর ওই লেভেলে নাই। কেননা, এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে গেলে আমরা অনেক কিছুই পাব না। তাই এজ এ মিডল পাওয়ার হিসেবে কীভাবে আমরা আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে পলিটিকস করব, এটা নির্ধারণ করতে হবে। এটা শুধু নির্ধারণ করলেই হবে না, যারা প্লেয়ার তাদের মাইন্ড সেট চেঞ্জ করতে হবে। কারণ, যে ধারনার ওপর ভিত্তি করে আমরা এতদিন ডিপ্লোমেসি করেছি তার অনেককিছুই ভেঙে পরেছে। এটা নানা কারণে ঘটেছে। আমাদের নিজেদের উন্নয়নের কারণে যেমন ভেঙেছে, পৃথিবীর উন্নয়নের কারণেও ভেঙেছে। তাই আগের ধারণা থেকে সরে আসতে হবে এবং সিস্টেমেটিক উপায়ে উপরে তুলতে হবে।’

ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যেমন ৫০, ৬০ বা ৭০ দশকে ভারতের যে ডিপ্লোমেসি বা নীতি ছিল সেটা কিন্তু এখন আর নাই। একদম চেঞ্জ হয়ে গেছে। ইন ফ্যাক্ট মোদি এসে এটাকে পুরো পাল্টে দিয়েছে। কেন পাল্টে দিয়ছেন? উনি বলছেন যে, ভারতকে একটা অফেনসিভ ডিপ্লোমেসিতে যেতে হবে। ভারত একটি বড় দেশ, অর্থনীতির দৃষ্টিতেও ভারত অনেক বড় দেশ। এই যে একটা মাইন্ডসেট ওনারা (ভারত) ডিপ্লোমেসির মধ্যে পরিবর্তন করলেন, এটা একটা কৌশলগত চিন্তার ফসল। তাই আমাদেরকেও এই প্রসেসে যেতে হবে। অর্থনীতিতে আমরা যে প্রসেসে ভারতের সমপর্যায়ে এসেছি, ঠিক একইভাবে কূটনীতিতেও যেতে হবে। কূটনীতি কিন্তু শুধুমাত্র অর্থনীতি না, কূটনীতি কিন্তু রাজনীতি, এটা রাজনীতির বরডার সেন্স। ওই জায়গাতেই আমি প্রাধান্য দিতে চাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন ফরেন সার্ভিসে জয়েন করি, তখনকার বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা যেমন ছিল, এখন কিন্তু সেই অবস্থায় নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) অলমোস্ট ডিসফাংশনাল হয়ে গেছে। যারা ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারাই সেখান থেকে বেরিয়ে গেছে। ফলে আমাদের মত ছোট ছোট দেশের জন্য অর্থনীতিতে যে সাপোর্ট ছিল সে জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেছে। এবং ক্রমশ আমরা মাল্টিলেটারাল থেকে বাইলেটারাল টেড্রের দিকে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমাদের আঞ্চলিক যে বাণিজ্য ব্যবস্থা ওইখানে আমাদের ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে, টিল দ্য টাইম উই হেভ নিউ ইন্টারন্যাশনাল টেড্রিং সিস্টেম, আমাদের নজর রাখতে হবে, কাজ করতে হবে। এই যে নতুন ট্রেডিং সিস্টেম হবে, এটা পার্ট অব ডিপ্লোমেসি। এইখানে আমাদের ভালো নজর রাখতে হবে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি ব্যবসায় নজর রাখব। কিন্তু ব্যবসাটা যে স্ট্রাকচারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, ওই স্ট্রাকচারে যদি আমরা কন্ট্রিবিউট না করি তবে ভবিষ্যতে আমাদের সমস্যা হবে। তাই এক্ষেত্রে নেগোশিয়েশনের জন্য ডিপ্লোমেসিকে তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ডিফেন্স বা সিকিউরিটি ইজ এ পার্ট অব ডিপ্লোমেসি, পার্ট অব বিজনেস। বৈশ্বিকভাবে ডিফেন্স ইন্ড্রাসট্রি খুব বড় ইন্ড্রাসট্রি। ব্যবসায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার নেগোশিয়েশনের চরিত্র পুরোটাই ভিন্ন। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন, এখানকার নেগোশিয়েটিং টেবিলেরও আলাদা কেমিস্ট্রি আছে। আমদের এইখানেও প্লে করতে হবে। সমুদ্রের যে কূটনীতি সেটাও ভিন্ন। সমুদ্র কূটনীতির রিজিওন ভিন্ন, এখানে যারা প্লে করে তারা ভিন্ন। এখানে নেভাল ফোর্সের একটা বড় জায়গা আছে। তাই এখানেও জোড় দিতে হবে। আবার এই সব ধরনের ডিপ্লোমেসির মধ্যে একটা সমন্বয়ও থাকতে হবে। যে কারণে জিও স্ট্র্যাটেজি কথা বলা হচ্ছে।’ মো. শহীদুল হক বলেন, ‘অনেক আগে ডিপ্লোমেসি রাজা-রানির জন্য ছিল। তারপর রাষ্ট্রের জন্য হয়েছে। আমি মনে করি, এখনকার ডিপ্লোমেসি জনগণের জন্য, ডিপ্লোমেসি ফর দ্য পিপল।’

‘বাংলাদেশ ফরেন পলিসি পেপার প্রস্তুত করতে হবে। যেখানে থার্ড সেক্রেটারি থেকে রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত সবাই জানবে যে কিসের ওপর ভিত্তি করে তাদের ডিপ্লোমেসি করতে হবে।’- এমন কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা বলে, আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পলিসি ঠিক করতাম। মনে হয়, এখনও ওই একই এক্সসারসাইজ আছে। আমি যখন পররাষ্ট্র সচিব ছিলাম তখন শেষেরদিকে এসে আমরা একটা বাংলাদেশ ফরেন পলিসি পেপার প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছিলাম ইন কনসালটেশন উইথ এভরি ওয়ান। আমাদের লক্ষ্য ছিল যে, আমরা এক সময়ে এটা পিপলস কনসালটেশনের জন্য থ্রো করব, পরবর্তীতে এটাকে মোডিফাই করা হবে। এমন কাজ আমাদের এখানে আগে কখনও করা হয়নি। আমি নতুন পররাষ্ট্র সচিবকে বলেছি যে, ওই প্রসেসটা শুরু করা দরকার। কেননা এই এক বছরের মধ্যে করোনাসহ একাধিক ইস্যুর কারণে বিষয়টা পাল্টে গেছে। তাই এটা রিভিজিট করা দরকার এবং আর্টিকুলেট করা দরকার। তাহলে থার্ড সেক্রেটারি থেকে রাষ্ট্রদূত সবাই জানবে যে এটার ওপর ভিত্তি করে আমাকে ডিপ্লোমেসি করতে হবে। এখন এই জিনিসটাই এডহকে চলছে, এখানে পরিবর্তন করতে হবে।’

কূটনীতি জিও স্ট্র্যাটেজি টপ নিউজ নির্ধারণ প্রয়োজন ফোকাস বাংলাদেশ সারাবাংলা

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর