Saturday 12 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নভেম্বরে নির্বাচন চান রেজাউল, তাড়া নেই শাহাদাতের


৩০ অক্টোবর ২০২০ ১৪:০৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্থগিত হয়ে থাকা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পক্ষে মত জোরালো হচ্ছে প্রার্থীদের। শীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হলেও অধিকাংশ প্রার্থীই চান ‘নির্বাচনটা হয়ে যাক’। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী চান, নভেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হোক। তবে বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের এত তাড়া নেই। দ্রুততার চেয়েও তার আগ্রহ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচনের দিকে।

বিজ্ঞাপন

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরপর ১ মার্চ মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হয়। ৮ মার্চ মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল। ৯ মার্চ প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। ২৯ মার্চ ভোটগ্রহণের কথা ছিল।

এর মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশেও। ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরে ১২ দিন ধরে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শেষে পরিস্থিতি বিবেচনায় ২১ মার্চ ভোটগ্রহণ স্থগিতের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। এরপর সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে গত একমাসে কয়েকটি শূন্য সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। তবে চসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে তোড়জোড় না থাকায় প্রার্থীদের মধ্যে অস্বস্তি এবং আদৌ বিদ্যমান তফসিলে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে। নির্বাচন কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, বিদ্যমান তফসিলে ভোটগ্রহণের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করে নির্বাচন হতে আইনি বাধা নেই।

এ অবস্থায় গত ৫ আগস্ট মেয়াদ শেষে বিদায় নেন চসিকের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং ৪১ জন সাধারণ ওয়ার্ডের ও ১৪ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এর আগেই সরকার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে চসিকের প্রশাসক হিসেবে ১৮০ দিনের জন্য দায়িত্ব দেন। ৬ আগস্ট সুজন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার মেয়াদ শেষ হবে ফেব্রুয়ারিতে।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে চসিক নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, বর্তমান প্রশাসকের মেয়াদকালের মধ্যেই নির্বাচন হবে। আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। খুব সম্ভবত প্রশাসকের মেয়াদের শেষ দিকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই একটা তারিখ ঘোষণা করা হবে। সে হিসেবে আমরা প্রস্তুত আছি, যখনই তারিখ ঘোষণা করা হোক না কেন, আমরা নির্বাচন করে ফেলতে পারব।’

বিজ্ঞাপন

স্থগিত হওয়া চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে ছয় জন, সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ১৬১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। ছয় মেয়র প্রার্থী হলেন— আওয়ামী লীগের এম রেজাউল করিম চৌধুরী, বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আবুল মনজুর এবং ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ। তবে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলেছে যথারীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর মধ্যেই।

মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের অধিকাংশের অভিযোগ, নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ায় চট্টগ্রাম শহরের সাধারণ নাগরিকরা কষ্টে আছেন। ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর নেই, মনোনীত প্রতিনিধিও নেই। মানুষ তাদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগের কথা কারও কাছে জানাতে পারছেন না। চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন ৪১ ওয়ার্ডকে তিন ভাগে ভাগ করে তিন জন কর্মকর্তাকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। সদ্য সাবেক কাউন্সিলরদের অভিযোগ, মাত্র তিন জন কর্মকর্তা দিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং তারা দ্বারস্থ হচ্ছেন বিদায়ীদের বাসায়-কার্যালয়ে।

এছাড়া প্রার্থীদের, বিশেষত আওয়ামী লীগের মনোনীতদের সাংগঠনিক সভা-সমাবেশে প্রতিনিয়ত উঠে আসছে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের দাবি। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ গত একমাস ধরে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে-ইউনিটে সাংগঠনিক সভা-সমাবেশ শুরু করেছে। সেখানে যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীও। নেতাদের বক্তব্যে রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও মূলত উঠে আসছে চসিক নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেনও নিয়মিত সাংগঠনিক সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। সেখানেও বিএনপি নেতারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে চসিক নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। মূলত প্রার্থীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন স্থগিত হওয়ার পর চসিক নির্বাচন নিয়ে হারিয়ে যাওয়া আমেজ ফিরিয়ে আনতে।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত একমাসে বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন হয়ে গেছে। দেশের পরিস্থিতিকে এখন স্বাভাবিক বলা যায়। দোকানপাট, অফিস, এমনকি সিনেমা হল পর্যন্ত খোলা। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন— সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে, বিয়ে-মেজবান হতে পারলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটা হতে বাধা কোথায়? যে যা-ই বলুক, চট্টগ্রামের মানুষ তো কষ্টে আছে। জন্ম সনদ-ওয়ারিশ সনদ পাচ্ছে না— মোটা দাগে সেবা থেকে তো তারা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিদিন শত, শত মানুষ আমার বাড়ির উঠানে এসে বসে থাকে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে। মানুষকে হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে, সম্ভব হলে ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনটা হয়ে যাক। মানুষ চায়, নভেম্বরের মধ্যেই যেন নির্বাচন হয়ে যায়। শুধু শুধু নির্বাচনটা ঝুলিয়ে রেখে কার লাভ হচ্ছে জানি না।’

বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, বর্তমান প্রশাসকের মেয়াদের মধ্যেই নির্বাচন হবে। সেভাবেই হোক, এত তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। তবে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি ও প্রার্থী হিসেবে আমার দাবি, বর্তমান সরকারের আমলে হারিয়ে যাওয়া ভোটের সংস্কৃতিটা ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষের মধ্যে ভোটের উৎসবটা ফিরিয়ে দিতে হবে। মানুষ যেন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা নির্বিঘ্নে দিতে পারে, রাষ্ট্রযন্ত্র, পেশীশক্তি ব্যবহার করে যেন তার ভোটটা কেড়ে নেওয়া না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে নির্বাচন হওয়া কিংবা না হওয়া একই কথা।’

নগরীর ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল হাসনাত মো. বেলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে রুটিন কিছু কাজ থাকে, ফলোআপ ওয়ার্ক থাকে। একজন জনপ্রতিনিধি ছাড়া মানুষকে সেসব সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ ওয়ার্ডের সচিবের পক্ষে তো মানুষের দোরগোড়ায় যাওয়া সম্ভব না, তিনি তো নির্বাচিত নন। তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন কাজ ও নাগরিক সেবাকে গতিশীল করতে হলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিকল্প নেই। এই বাস্তবতায় আমি মনে করি যে, নির্বাচনটা হয়ে যাওয়া উচিত।’

নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী, রামপুর ও উত্তর হালিশহর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জেসমিনা খানম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচনটা হয়ে যাক। একটা স্থগিত হওয়া নির্বাচন, এটা তো বাতিল হয়নি, এটা দীর্ঘায়িত করা ঠিক না। কারণ যেকোনো ভোটের প্রচার-প্রচারণার সময় একাধিক প্রার্থী নিয়ে এলাকায়-এলাকায় একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়। ভোটের পর আবার সবাই মিলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এবারও হয়েছিল। নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এই গ্রুপিংটা এলাকায়-এলাকায় এখনও রয়ে গেছে। একটা সংঘাতমুখর পরিস্থিতি কিন্তু প্রত্যেক এলাকায় আছে। এই সংঘাত বন্ধ হবে ভোটটা হয়ে গেলে।’

নগর আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক ও আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচন যত দ্রুত হবে মানুষের জন্য ভালো হবে। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন অভিযোগ, চাহিদা নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে যান। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় তারা সেগুলোর কোনো সমাধান পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে তারা আমরা যারা কিছুদিন আগেও কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করেছি, আমাদের কাছে আসেন। এমনকি আমার বাসায় পর্যন্ত লোকজন ভিড় করছেন। কিন্তু আমরা তো কোনো সমাধান দিতে পারছি না। এলাকার অলি-গলিতে, পাড়ায় অনেক ছোটখাট সমস্যা থাকে। সেগুলো স্থানীয়ভাবেই সমাধান করতে হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেখানেও সমস্যা হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের সভাপতি ও লালখানবাজার-জামালখান-বাগমনিরাম সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মনোয়ারা বেগম মণি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনটা বিলম্বিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। পাসপোর্টের আবেদন, জন্ম সনদ, জাতীয়তা সনদ, ছোটখাটো বিরোধ মীমাংসা, এমনকি বৃষ্টি হলে পাহাড় থেকে লোকজনকে সরাতে মাইকিংয়ের মতো বিষয়গুলো তো একজন প্রশাসক এবং কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে পূরণ সম্ভব নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় মানুষকে বিভিন্ন কাজে দিনের পর দিন হয়রানি সহ্য করতে হচ্ছে। এজন্য বলছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনটা হয়ে গেলে মানুষ কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে।’

তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এই মুহূর্তে শহরজুড়ে লাখো মানুষের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন আপাতত না করার পক্ষেও মত আছে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি আসনের উপনির্বাচন এবং পুরো চট্টগ্রাম শহরজুড়ে নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য আছে। দেশে করোনা পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সুতরাং এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনটা না করা উচিত বলে আমি মনে করি। উপনির্বাচনগুলোতে দেখেছি, মানুষ এমনিতেই ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না। তাদের মধ্যেও নিশ্চয় করোনা নিয়ে ভীতি আছে। সুতরাং মানুষের দোহাই দিয়ে যেকোনো উপায়ে নির্বাচন করে ফেলাটা আত্মঘাতী হবে বলে মনে করি।’

এম রেজাউল করিম চৌধুরী করোনাভাইরাস চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন চসিক চসিক নির্বাচন চসিক প্রশাসক শাহাদাত হোসেন স্থগিত নির্বাচন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর