Monday 30 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাবা নেই, মা কারাগারে— আশ্রয়ের নামে জুটেছে শুধুই নির্যাতন!


৩ নভেম্বর ২০২০ ১৬:৪০

ঢাকা: ছোটবেলায় বাবা মারা গেছেন। মা-ও কোনো এক অপরাধে কারাগারে। ফলে শিশুটি বেড়ে উঠছিল দাদির কাছে। অভাবের সংসারে হয়তো শিশুটির নির্ভার ভবিষ্যতের চিন্তায় দাদিও চেয়েছিলেন তার নিরাপদ আশ্রয়। এজন্য এলাকার পরিচিত ভেবে বাচ্চাটিকে তুলে দেন মঈনুল-সুরমা দম্পতির হাতে। কিন্তু দীনতায় বেড়ে ওঠা শিশুটির নিরাপদ আশ্রয়ের পরিবর্তে কপালে জুটছে শুধুই নির্যাতন। মঈনুল-সুরমা দম্পতির অসহনীয় নির্যাতনের ফলে শিশুটির চিৎকার আশপাশে বসবাসরত অনেকের কানে পৌঁছেছিল। কিন্তু অনুভূতিহীন এই শহরে বাচ্চাটির কান্না দুই বছরেও কারও হৃদয়ে সহানুভূতি তৈরি করতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন এক মানবিক হৃদয়ের মানুষ। তিনি প্রমাণ করলেন মানবতা কিংবা মানবিকতা কোনোটাই এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর গুলশানের কালাচাঁদপুরের মোড়লবাজার এলাকার বাসিন্দা সানজিদা আক্তার নিশো। শিশুটির উপর নেমে আসা এমন অমানবিক নির্যাতনে আশপাশের অন্যদের মতো তিনি কিন্তু চুপ করে বসে থাকেননি। তিনিই প্রথম শিশুটির উপর নেমে আসা নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন এবং শিশুটিকে উদ্ধারে বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’-এ কল দিয়ে নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে সহায়তা চান। তার কল পেয়ে গুলশান থানা পুলিশ রাতে গিয়েই শিশুটিকে উদ্ধার করে।

বিজ্ঞাপন

সানজিদা আক্তার নিশো শিশুটির উপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখানে (কালাচাঁদপুর) বাসা নিয়েছি প্রায় আট মাস। এখানে আসার পর থেকেই প্রতিদিন কোনো না কোনো সময় শিশুটকে মারধরের শব্দ শুনতাম। প্রথম প্রথম কয়েকদিন চেষ্টা করেছি ঘটনা জানার। কিন্তু আমরা যে বিল্ডিংয়ে থাকি তার পাশের বিল্ডিংয়ে থাকেন মঈনুল-সুরমা দম্পতি। তাই যেতে পারতাম না। কিন্তু আমাদের বারান্দা থেকে তাদের ফ্লোরের কিছু অংশ দেখা যেত। এ কারণে শিশুটিকে মারধরের পর সে যখন বারান্দায় এসে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতো তখন ভীষণ মায়া হতো। ওর জন্য অনেক কষ্ট পেতাম। এক পর্যায়ে ওই ভবনের কয়েকজনকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। তারা বলেছিল, শিশুটি তাদের সন্তান। তাই এ বিষয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতো না। কিন্তু একদিন আমি শিশুটির সঙ্গে একটু কথা বলতে পেরেছিলাম। তখন সে জানালো যে, সে এখানে কাজ করে।’

সানজিদা নিশো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এইটুকু একটি বাচ্চা। যার বয়স ৮-১০ বছর হবে। সে কিনা দুহাতে ঘর মোছা থেকে শুরু করে সব কাজ করতো। এটা আমাকে ভীষণ ভাবাতো। কারণ আমিও তো মা। আমারও সন্তান আছে। এছাড়া শিশুটিকে নির্যাতন করা হতো। এসব নিয়ে মনপীড়ায় ভুগতাম। দীর্ঘদিন ধরে আমি চেষ্টা করছিলাম শিশুটিকে উদ্ধারের। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণের ব্যবস্থা করতে পারিনি। তাই এতদিন কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’

তিনি বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেও শিশুটিকে মারধর করেছিল। দেয়ালের সঙ্গে তার মাথা ঠেকিয়ে তাকে মারতো। আর শিশুটিকে যখন ওই নারী (সুরমা) মারতো তখন তার স্বামী সোফায় বসে পা নেড়ে নেড়ে টিভি দেখতো। অথচ শিশুটির নির্যাতনের দৃশ্য দেখলে যে কারও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে। কিন্তু তাদের মত পাষণ্ডরা এটাকে আনন্দ মনে করতো। কিন্তু সেদিনও আমার কাছে কোনো প্রমাণ না থাকায়, আর শিশুটিও তেমন কোনো কথা না বলতে পারায় কেউ আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। আমি বাসার নিচে গিয়ে কয়েকজনকে বলেছিলাম। কিন্তু সেদিন প্রমাণের অভাবে কিছু হয়নি। কিন্তু গতকাল সোমবার (২ নভেম্বর) আবারও বিকেল তিনটার দিকে শিশুটিকে মারছিল। দেয়ালে ঠেকিয়ে মারধর করার কারণে শব্দ পেয়ে আমি বারান্দায় গিয়ে ভিডিও করেছিলাম। কিন্তু তাদের রুমে অন্ধকার হওয়ায় তেমন কিছু ধারণ করতে পারিনি। কিন্তু নির্যাতনের প্রমাণ নিয়েছি। পরে তাৎক্ষণিক ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের অনুরোধ জানাই। পরে পুলিশ এসে শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়।’

সানজিদা নিশো বলেন, ‘আমি সকালে শিশুটিকে দেখতে হাসপাতাল গিয়েছিলাম। তার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিচ্ছি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো ওই দম্পতি শিশুটিকে যে শুধুই যা মারধর করতো তা কিন্তু নয়। শিশুটির গোপানাঙ্গেও নির্যাতন করতে করতে কালো দাগ করে ফেলেছে! এটা কেমন নির্মমতা?’

শিশুটিকে উদ্ধারের সময় অভিযানে থাকা গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মশিউর সারাবাংলাকে বলেন, ‘থানায় খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করি। রাতেই শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে নাক-কান-গলাসহ যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। পরে সেখান থেকে তেঁজগাও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে আসি।’

তিনি বলেন, ‘শিশুটির উপর ভীষণ অমানবিক নির্যাতন হয়েছে। নির্যাতনের চিত্র দেখে আমাদের ওসি স্যার সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশ দিলেন নির্যাতনকারীদের গ্রেফতার করতে। পরে নির্যাতনে জড়িত স্বামী মঈনুল হোসেন ও স্ত্রী হাওয়া বিবি ওরফে সুরমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেইসঙ্গে নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের হরা হয়েছে।’

এসআই মশিউর বলেন, ‘শিশুটি তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে অভিযুক্তরা বলছে, শিশুটিকে কিশোরগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে। শিশুটির বাবা মারা গেছে, মা জেলে। তাই শিশুটিকে তার দাদির কাছ থেকে লালন-পালন করার কথা বলে হয়তো এনেছে- এমনটাই ধারণা করছি আমরা।’

এ বিষয়ে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্যাতনের খবর পেয়েই শিশুটিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। সেইসঙ্গে অভিযুক্ত দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেশি একজন বাদী হয়ে মামলা করেছেন।’

ওসি বলেন, ‘শিশুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে ঢাকা মেডিকেলের ওসিসিতে পাঠানো হয়েছে। শুনেছি শিশুটির জেলা কিশোরগঞ্জ। কিন্তু বাকি কোনো ঠিকানা আমরা পাচ্ছি না। যদি কেউ শিশুটির পরিবারের স্বজনদের খোঁজ পায় তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ করছি।’

মামলার বাদী সানজিদা আক্তার নিশো সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি জানি মামলা মানেই হয়রানি। নানান ঝামেলা। কিন্তু যত ঝামেলা, যত বিপদই আসুক- তা আমি মোকাবিলা করবো। তবুও আমি চাই, শিশুটি নির্যাতন থেকে বাঁচুক। আর যদি শিশুটির দায়িত্ব কেউ নিতে না চায়- আমিই নেবো।’ এজন্য তিনি মানবিক নাগরিকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

আশ্রয় নির্যাতন বাবা নেই মঈনুল-সুরমা দম্পতি মা কারাগারে শিশু

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর