‘নির্বাচনি প্রহসন, এটাও তো জিয়াউর রহমানেরই শুরু করা’
৩ নভেম্বর ২০২০ ২২:৫৫
ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকে ভোট নিয়ে যারা কথা তোলেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, জিয়ার নির্বাচন দেখুক আর এরশাদের নির্বাচন দেখুক। আমরা আওয়ামী লীগ সব সময় নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু আমরা নির্বাচনের কি চেহারা দেখেছি? সেখানে তো জনগণ লাগেনি। কথাই ছিল দশটা হুন্ডা, বিশটা গুন্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা। এটাই তো বাস্তবতা। এই নির্বাচনি প্রহসন, সিল মারো, বাক্স ভরো, আর খালি ঘোষণা দেও! এটা তো জিয়াউর রহমানেরই শুরু করা।’
মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) বিকেলে রক্তাক্ত-শোকাবহ ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনায় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন।
কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রান্তে আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্যে রাখেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুসন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা, সহযোগি ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। গণভবন প্রান্ত থেকে সভাটি পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।
সভার শুরুতেই ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারীদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরাবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে? এই নির্বাচনে কারা শুরু করেছিল? জিয়াউর রহমানের হ্যাঁ-না ভোট। ব্যালট বাক্স কেউ খুঁজে পায়নি। একশো ভাগের উপরে ভোট হয়ে গেল তার পক্ষে? তারপর তার রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের প্রহসন? এই নির্বাচনি প্রহসন, সিল মারো, বাক্স ভরো, আর খালি ঘোষণা দেও! এটা তো জিয়াউর রহমানের’ই শুরু করা আছে। এরপরে তার রাজনৈতিক দল গঠন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল হিসাবে যারা পরিচয় দেয় তারা কাদের ভিতর তৈরি করা?
তিনি আরও বলেন, আজকে বিএনপি দেখি মাইক একটা লাগিয়ে সারাদিন বসে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছে, সমালোচনা করে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন আছে? এই রাজনৈতিক দলটার জন্ম কোথায়? এই রাজনৈতিক দল তো মাটি মানুষের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠেনি। যেমন-আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গড়ে তুলেছিলেন বা আওয়ামী লীগ যারা গড়ে তুলেছিলেন তারা তো ক্ষমতায় ছিলেন না? তারা ক্ষমতায় না থেকে জনগণকে নিয়েই এই সংগঠনটা গড়ে তুলেছেন, জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করবার জন্য, মাটি-মানুষকে নিয়েই এই সংগঠন গড়ে উঠেছে এবং তারা দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলেছে। আর বিএনপি জন্মস্থানটা কোথায়? সেটা তো ক্যান্টনমেন্টে। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান, সেই ঘোষিত রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতায় বসে একটা নির্বাচনি প্রহসন করে তারপরে একটা দল গঠন। ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে দিয়ে যে দলের সৃষ্টি হয়, সে দল জাতিকে কি দেবে? জাতির জন্য কি করতে পারে তারা?
দেশের জন্য কি করতে পারে? সেই সাথে এই দেশে দুর্নীতির বীজটা বপন করেছে। কারণ এই দল ভারী করার জন্য কিছু লোককে অবৈধভাবে অর্থ বানাবার সুযোগ দিয়েছে, দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েছে। ব্যাংকে টাকা নিলে শোধ দিতে হবে না। ঋণ খেলাপীর সুযোগ দিয়েছে। একটা এলিট শ্রেণি তৈরি করেছে। যাদের উপর নির্ভর করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করেছে। এটা হল বাস্তবতা।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ঠিক একই প্রক্রিয়া আমরা দেখলাম, আবার ক্ষমতা বদল ওই কাজের মধ্য দিয়েই। আসলো জেনারেল এরশাদ। সেও সেই জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই একদিন নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিল। ঘোষণা দিয়ে আবার সেই একই প্রক্রিয়ায় দল গঠন। সে দলও গঠিত হল ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী দিয়ে। এই সব দল যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল তখন দেশের কি উন্নতি হয়েছে? দেশের শুধু না সাধারণ মানুষের কি উন্নতি হয়েছে? তারা কি দারিদ্র্য বিমোচন করতে পেরেছে? তারা কি খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করতে পেরেছে? তারা কি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে পেরেছে?
‘মানুষকে তারা কিছুই দিতে পারিনি। নিজেরা সম্পদশালী অর্থশালী হয়েছে। কিন্তু একবার তাকিয়ে দেখেন, যারা এইভাবে ক্ষমতায় এসেছিল তারা নিজেরা কত অর্থশালী সম্পদশালী হয়েছে? কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য তারা পরিবর্তন করতে পারেনি, চায়ওনি। কারণ তাদেরকে (জনগণ) সবসময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশের মানুষকে ভালবেসে তাদেও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে এই দেশ স্বাধীন করেছেন। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি যদি দশটা বছর সময় পেতেন, বাংলাদেশ সারাবিশ্বে উন্নত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারত। কিন্তু সেটা করতে দেয়নি।
নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের একটি শ্রেণি আছে তাদের কাজই হচ্ছে সরকারের সমালোচনা করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে জিয়া, এরশাদ এবং এরপরে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছে। এদের মূল লক্ষ্যই ছিল- দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, খুন ও সমাজে সংঘাত সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জিয়া-এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে নির্বাচন কেমন ছিল? ১০টা হুন্ডা, ২০টা গুন্ডা- নির্বাচন ঠান্ডা। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ভোটে হারেনি, ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছিল। আর খালেদা জিয়া এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে তালিকা করেছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, সেই সময় অনেকেই জিয়া গণতন্ত্র দিয়েছে? একেবারে বহুদলীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা বলে অনেকেই চলে গেছে তার সাথে। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। কিন্তু একবারও কি তারা ভেবে দেখেছেন? যারা অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় আসে, তারা গণতন্ত্র দিতে পারে না। আর সে গণতন্ত্র গণতন্ত্র হয় না। কতগুলি দল করতে পারলেই সেটা গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা হয় না। তাই যদি হত, এদেশের অনেক উন্নতি হতে পারত। কারণ মানুষের কাছে জবাবদিহি থাকতে হয়। মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারে। কিন্তু সেটা তারা করেননি।’
‘কিন্তু আমাদের ঠিক একটা শ্রেনী আছে। তাদের চরিত্রটাও আমরা দেখি। জিয়া তারপরে এরশাদ এরপরে আসল খালেদা জিয়া। আমরা একটু বিচার করে দেখেন; একটার পর একজন আসছে, তাদের মূল্য লক্ষ্যটাই ছিল দুর্নীতি। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, হত্যা গুম, সারাদেশে একটা অরাজকতার সৃষ্টি করে সংঘাত সৃষ্টি করে ক্ষমতায় ঠিকে থাকা‘- বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়ার আমলে ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনি প্রহসনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আন্দোলন করেছি। মার্চের ৩০ তারিখে খালেদা জিয়া জনগণের অভ্যুত্থানে বাধ্য হয়েছিল পদত্যাগ করতে। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তাকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল ভোট চুরির অপরাধে, বিএনপির যে নেতারা কথা বলে তাদেরকে এই কথাটা আপনারা দয়া করে স্মরণ করিয়ে দেবেন। কারণ মানুষ তো ভুলে যায়। খালেদা জিয়াকে ৩০ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল কেন?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরবর্তীতে তাদের দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস এবং অপকর্মের কারণে এদেশে এমাজেন্সি জারি হয়। ২০০৭-এ আসে সেই এক/এগারোর সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ারই পরিচিত এবং তারি হাতে তৈরি। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদকে খালেদা জিয়াই নিয়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর বানিয়েছিল। ৯ সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে মঈন উ আহমদকে সেনা প্রধানও করেছিলেন এই খালেদা জিয়া। এরা সবাই তার পছন্দের লোক ছিলেন।
‘কিন্তু তারপর আমরা কি দেখলাম, তারাও এসে চেষ্টা করল এক দল গঠন করতে। সেই দল গঠনের ইতিহাস নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাননি। মোবাইল ফোন বাংলাদেশে ছিল না। সে ব্যবসাটা আমি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম সকলের কাছে।‘
ড. ইউনুসকেও একটা মোবাইল ফোনের ব্যবসা দিয়েছিলাম। সেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আমাদের ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং গ্রামীণ ফোনের ইউনুস তারা গেলেন রাজনৈতিক দল করতে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ৭০ জনের তালিকা করে দল গঠন করতে গেলেন। জনগণের সাড়াও পেলেন না, দল গঠন করতে পারলেন না।‘
‘আরেকজন আমাদের ছাত্রনেতা, আমাদের সাথেই ছিলেন। পরে চলে গিয়েছিলেন। এখন অবশ্য মারা গেছে। তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না। কারণ একসময় আমরা ছাত্ররাজনীতি করেছি। আমাদেরই নেতা ছিল, পরে চলে গিয়েছিল। নতুন দল গঠনের চেষ্টা করা হলেও জনগণ তাতে সমর্থন দেয়নি। আবার ওয়ান-ইলেভেনে চলে এলো কিংস পার্টি করতে। সেখানেও জনসমর্থন পেল না। তারপর আমাকে গ্রেফতার করল সর্বপ্রথম, খালেদা জিয়ার দেওয়া ১২টা মামলা আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিল আরও ৫-৬টা মামলা। কাজেই এভাবে পুরো রাজনীতি ধ্বংসের দিকে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। কিন্তু আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই প্রতিবাদ শুরু করল। ওই এমার্জেন্সির মধ্যে যখন প্রতিবাদ শুরু হল তখন তারা বাধ্য হল এবং আন্তর্জাতিক চাপে ইলেকশন দিতে।’