হাঁসের ঝাঁকে হাসছে জীবন
৯ নভেম্বর ২০২০ ০৮:২৫
সিরাজগঞ্জ: উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালনের মাধ্যমে অভাবকে জয় করে ভাগ্য পাল্টে নিচ্ছে সিরাজগঞ্জের গ্রামাঞ্চলের অনেক গৃহবধু ও বেকার নারী-পুরুষ। জেলার নয়টি উপজেলায় ২৩৬টি খামারে এখন হাঁস পালন হচ্ছে। এই হাঁসের মাংস ও ডিম স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলে হাঁস পালনের সাফল্যে অন্যরাও উৎসাহিত হয়ে গড়ে তুলছেন ছোট-বড় খামার। এতে প্রাণিজ পুষ্টির ঘাটতি পূরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে খামারগুলো।
সরেজমিনে কয়েকজন খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংক ঋণ ও নিজের কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াই। এদের মধ্যে নুরুল ইসলাম, মাসুদ রানা ও মরিয়ম প্রথমে ৮০০ থেকে ৯০০টি হাঁসের বাচ্চা কিনে শুরু করেন হাঁস পালন। ধীরে ধীরে বাচ্চাগুলো বড় হয়ে তিন মাস পরই ডিম দেওয়া শুরু করে। কঠোর পরিশ্রমে ধীরে ধীরে ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে তাদের। বর্তমানে জেলার অনেক খামারিরা বেকারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
উল্লাপাড়া উপজেলার খামারিদের মধ্যে সফলতা পেয়েছেন মো. নুরুল ইসলাম। তিনি জানান, বেকার অবস্থায় বিয়ে করায় পরিবারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। অভাবের তাড়নায় পেটের দায়ে অন্যের হাঁস-মুরগির খামারে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। পরে সেখানকার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ২০১০ সালে নিজ এলাকায় হাঁসের খামার করার পরিকল্পনা নেন। প্রথমে ৯০০টি হাঁসের বাচ্চা দিয়ে শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতার ফলে তিনি এখন স্বাবলম্বী। উপজেলার মধ্যে তিনি এখন একজন সফল হাঁস খামারি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে তার খামারে আড়াই হাজার হাঁস রয়েছে।
কামারখন্দের আরেক সফল খামারি মাসুদ রানা বলেন, ‘হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ৮০০টি হাঁস নদীর পানিতে পালন করছি। এই হাঁস আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন ছোট ভাইয়ের সরকারি চাকরির আর ঘুষের টাকা জোগাবো না। সেই টাকা হাঁসের খামারের কাজে লাগাবো।’
তিনি জানান, মাত্র সাড়ে চার মাস বয়সেই খাকি ক্যাম্ববেল হাঁস ডিম দিতে থাকে। একটি হাঁস বছরে ৩০০ ডিম দিয়ে থাকে। আর এই হাঁস ডিম দেয় টানা তিন বছর। ক্যাম্ববেল হাঁসের মাংস মুরগির মতোই পুষ্টিকর। এই হাঁস পালনে বেশি পানিরও প্রয়োজন হয় না। হাঁসের খাবার ও গলা ডোবানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পেলেই এরা সহজ ও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করে বেঁচে থাকতে পারে।
একই উপজেলার সফল হাঁস পালনকারী মরিয়ম বেগম জানান, পাঁচ বছর আগে ছেলেমেয়ে নিয়ে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করেছেন। পরে এলাকার একজন সফল খামারির পরামর্শে ৫০০টি হাঁসের বাচ্চা কেনেন তিনি। এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন রোগের কারণে কিছু হাঁস মারা গেলেও প্রায় সাড়ে তিনশ হাঁস ডিম দেওয়া শুরু করে। বাড়ির পাশেই বিশাল বিল থাকার কারণে বাড়তি খাবার দিতে হয়নি। বিলের মধ্যে থাকা ছোট ছোট মাছ আর শামুক খেয়েই বেড়ে উঠেছে হাঁসগুলো। বর্তমানে হাঁসের ডিম বিক্রি করে সংসার খুব ভালোভাবেই চলছে। সংসারের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ করেও সে অনেক টাকা সঞ্চয় করতে পারছেন।
তিনি জানান, গ্রামের বিলে অল্প পানিতে উন্মুক্তভাবে হাঁস পালন করা যায়। কারণ হাঁস বেঁধে রেখে পালন করা ব্যয়বহুল। এ কারণে উন্মুক্তভাবে পালন করতে হয়।
কৃষিনির্ভর দেশে বেকার যুবকদের হাঁস পালনের পরামর্শ দিয়ে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, ‘মাসুদ ও মরিয়মের মতো যদি বেকার নারী-পুরুষরা চাকরির পেছনে না ছুটে অল্প পুঁজি নিয়ে হাঁসের খামার শুরু করেন তাহলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা দূর হবে অন্যদিকে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান ভুঁইয়া জানান, জেলায় ২৩৬টি হাঁসের খামার রয়েছে। ভাসমান পদ্ধতিতে হাঁস পালনে খরচ অনেকটাই কম, তবে লাভ তুলনামূলক বেশি।
হাঁসপালনে খামারিদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিতে না পারলেও নিয়মিত হাঁসের চিকিৎসা, টিকা ও পরামর্শ দেওয়া হয় বলে জানান প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
উল্লাপাড়া কামারখন্দ কৃষিনির্ভর দেশ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জ হাঁস পালন