Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৫ জনে একজন করোনা পজিটিভ


১১ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৪৩

ঢাকা শিশু হাসপাতাল। ছবি: ঢাকা শিশু হাসপাতালের ওয়েবসাইট থেকে

ঢাকা: রাজধানীর শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা প্রতি পাঁচ জন শিশুর মধ্যে একজনের মধ্যে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পাওয়া গেছে। হাসপাতালটির বহির্বিভাগে গত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই সাত মাসে মোট ৫৩৩টি শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসে এই হাসপাতালে। তাদের নমুনা পরীক্ষা করে ১১০টি শিশুর মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে, যা মোট শিশুর ২০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপসর্গহীন এই শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণের এই হারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সে তুলনায় নবজাতক ও শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণের আশঙ্কা এবং তাদের ক্ষেত্রে কোভিডের প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার আশঙ্কা খুব কম বলেই ধারণা করছিলেন তারা। তবে শিশু হাসপাতালের এই চিত্র সেই ধারণার সঙ্গে নিঃসন্দেহে সাংঘর্ষিক। কেননা, শিশুদের মধ্যে প্রাপ্ত এই সংক্রমণ শনাক্তের হার জাতীয় পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারের তুলনায় বেশি। গত দুই মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে এই হার প্রায় দ্বিগুণ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে দেশে তিন লাখ ৮২ হাজার ১৮০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৫ হাজার ৭৯২ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। নমুনা পরীক্ষা বিপরীতে এই একমাসে শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পরের মাস, অর্থাৎ ৮ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে চার লাখ তিন হাজার ৩৪টি নমুনা পরীক্ষার বিপরতে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল ৪৫ হাজার ৬১৩ জনের মধ্যে। সে হিসাবে নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এই একমাসে শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন। অথচ শিশু হাসপাতালের সাত মাসের তথ্য বলছে, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

এর আগে, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) ও রাজধানীর শিশু হাসপাতালের এক যৌথ গবেষণাতেও শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব দেখা গেছে। একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত সেই গবেষণার অধীনে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ২৯ মার্চ থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত যে নবজাতকরা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল, কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের জন্য তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ৮৩টি নবজাতকের নমুনা পরীক্ষা করে ২৬টির শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়। এদের সর্বোচ্চ বয়স ছিল আট দিন। করোনা সংক্রমিত ২৩টি নবজাতকের মধ্যে ১২টি শারীরিকভাবে সুস্থ ছিল, আট জন মারা যায়, তিন জন এখনো চিকিৎসাধীন, বাকি তিন জন চিকিৎসা না নিয়েই হাসপাতাল ত্যাগ করেছিল। যে আটটি নবজাতক মৃত্যুবরণ করে, তাদের মধ্যে দু’টির মৃত্যু হয় কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমিত হওয়ার কারণে। বাকি ছয়টি নবজাতকের নানা ধরনের কো-মরবিডিটি ছিল।

শিশু হাসপাতালের গত সাত মাসের তথ্য এবং শিশু হাসপাতাল ও সিএইচআরএফের গবেষণার তথ্য বলছে, নবজাতক ও শিশুদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বড় অংশই উপসর্গহীন। তারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে নবজাতকদের মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব বিশদভাবে বুঝতে হলে আরও ব্যাপক পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুদের জন্য নিরাপদ একটি পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রতি জোর দিচ্ছেন তারা।

রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশ বা বিশ্ব পরিস্থিতিও যদি বিবেচনা করা হয়, তবে শুরুর দিকে নবজাতকদের মধ্যে সংক্রমণের বিষয়টি তেমনভাবে সামনে আসেনি। তবে আমরা আমাদের হাসপাতালে ইনডোর ও আউটডোরে আসা সব শিশুর নমুনা পরীক্ষা করিয়েছি আরটি পিসিআরের মাধ্যমে। এ সময়ে আমরা হাসপাতালে নবজাতক বাচ্চা যারা চিকিৎসা নিতে আসছিল, তাদের নমুনাও সংগ্রহ করি। ২৯ মার্চের পর থেকে আমরা এই কাজ শুরু করি। নমুনা পরীক্ষায় আমরা নবজাতকদের মাধ্যেও সংক্রমণ দেখতে পাই। একইসঙ্গে দেখতে পাই, বিভিন্ন বয়সী শিশুরা উপসর্গহীন থাকলেও তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এখনো প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫টি শিশুর নমুনা পরীক্ষা করে আমরা চার থেকে পাঁচজনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ দেখতে পাচ্ছি।

তিনি বলেন, এটা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকতে পারে। এসব শিশুদের অভিভাবকরা হয়তো বাইরে যাওয়া-আসা করেন। পরে শিশুরা তাদের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া, শিশুদের কোভিড-১৯ হয় না বলে এক ধরনের ধারণা প্রচলিত থাকার কারণেও হয়তো তাদের নমুনা সেভাবে পরীক্ষা করানো হয়নি। তবে শিশু হাসপাতালে আমরা চেষ্টা করেছি সব শিশুকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে নমুনা পরীক্ষার আওতায় আনতে। এর ফলে সংক্রমণের এই চিত্র পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আসলে পরিবারের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

শিশু হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট ডা. কিঙ্কর ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির শুরু থেকেই আমরা শিশু হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এখানে ভর্তি থাকা শিশুদের পাশাপাশি বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদেরও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে বহির্বিভাগে আসা অধিকাংশ শিশুরই কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কোনো উপসর্গ ছিল না। তারপরও তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরে তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। অর্থাৎ উপসর্গ না থাকলেও শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে।

ডা. রিজওয়ানুলের মতো ডা. কিঙ্কর ঘোষও বলছেন, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯ উপসর্গহীন থাকছে। এটা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আসলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে বাচ্চাদের কোভিড-১৯ হয় না— এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সবার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নওশাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নবজাতকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। আবার অন্যান্য জটিল রোগ আক্রান্ত হওয়ার পর যেসব শিশুকে হাসপাতালে আনতে হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। এই দুই ক্ষেত্রে বাচ্চাদের কোভিড-১৯ ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার যেসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো, তারা আক্রান্ত হলেও খুব দ্রুতই সংক্রমণ থেকে ভালো হয়ে উঠছে। সুতরাং শিশুদের কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হলে সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি আরও বিশদভাবে বুঝতে ব্যাপক আকারে জরিপ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে তথ্য সংগ্রহ করেছে তা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। তারা এভাবে প্রতিটি শিশুর আলাদাভাবে তথ্য রেখেছে— এটার জন্য তারা অভিনন্দন পেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে— যে শিশুরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল তাদের মধ্যে একটা জরিপ, যেটাকে বলা হয় অকারেন্স অব ডিজিজেস, কমিউনিটির মধ্যে র‌্যান্ডম স্যাম্পলিং করে এই জরিপটা করা গেলে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হতো। তবে এটাকে কমিউনিটির সামগ্রিক চিত্র বলা না গেলেও কমিউনিটিরই একটি অংশের চিত্র হিসেবে বিবেচনা করতেই হবে। তবে ঢাকা শহর বা সারাদেশের চিত্র বুঝতে গেলে প্রয়োজন ব্যাপক আকারে একটা জরিপ চালানো।

তিনি আরও বলেন, আরেকটি বিষয় হলো— এই পরিসংখ্যান কিন্তু হাসপাতালের চিত্র বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ যেসব শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে, তাদের মধ্যে যে উপসর্গহীন থেকে যাচ্ছে অনেকে, তাও বোঝা যাচ্ছে। এই তথ্য সব হাসপাতালের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন, উপসর্গহীন থাকলেও তাদের সবাইকে নমুনা পরীক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন।

কোভিড প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, শতাংশ পরিমাণ হিসাব করলেও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার একেবারে কম নয়। কিছুদিন আগে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে ঢাকা শহরের কিছু অংশ নিয়ে জরিপের যে ফল প্রকাশ করে, তাতেও উপসর্গহীনদের মধ্যে সংক্রমণ দেখা গেছে, যাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। শিশু হাসপাতালের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও অনেকটা তেমনই দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। অর্থাৎ উপসর্গহীন থাকার পরও অনেকের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। উপসর্গহীনদের ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

শিশুদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে মনে করেন ডা. নজরুল। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেকেই এখন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বাইরে যাচ্ছে। তারা বাসায় এসে যখন সরাসরি বাচ্চাদের সংস্পর্শে চলে আসছেন, তখন কিন্তু বাচ্চারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন সারাবাংলাকে বলেন, এখন কিন্তু স্কুল বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সেক্ষেত্রে শিশুদের স্কুল থেকে কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। এর অর্থ, শিশুরা কিন্তু পরিবার-পরিজনের কাছ থেকেই সংক্রমিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে হলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ফাইল ছবি

উপসর্গহীন সংক্রমণ করোনাভাইরাস কোভিড সংক্রমণ কোভিড-১৯ শিশু হাসপাতাল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর