Tuesday 08 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনার থাবায় চরম জীবিকা সংকটে প্রবাস ফেরত ৩ লাখ কর্মী


১৪ নভেম্বর ২০২০ ১৫:২১
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা: চৌদ্দগ্রামের বাসিন্দা মো. রমজান আলীর (৬৫) ছেলে মোস্তাফিজ (৪২) সৌদি আরবের একটি তেল শোধনাগারে ১৭ বছর ধরে ভালো বেতনে কাজ করতেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার এক মাস পরে কোম্পানিতে বড়সড় ছাঁটাই হলে তার চাকরি চলে যায়। লকডাউন দীর্ঘ মেয়াদী হতে যাচ্ছে জেনে এপ্রিলে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়।

মোস্তাফিজ জানান, এখন সৌদিআরবে আবার ফিরে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে। কিন্তু সে জন্যও অপেক্ষা করতে হবে। এরমধ্যে সাতমাস ধরে দেশে বেকার হয়ে আছেন। যা পুঁজি ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে।

ভিটেমাটি বিক্রি করে ২০১৬ সালে কাতার গিয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের মোসলেউদ্দীন মুসা (৩১)। চুক্তি অনুযায়ী তার বৈধতা শেষ হওয়ায় মার্চে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কাগজপত্র ঠিক করে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, কাতারে যাওয়ার পর তার অভিবাসন ব্যয় ওঠেনি। এদিকে দেশে নতুন করে শুরু করার সামর্থ্য তার নেই।

বিজ্ঞাপন

কেউ কাজ হারিয়েছেন করোনাভাইরাস মহামারির কারণে, কেউ হারিয়েছেন বৈধতা না থাকায় আবার কেউ করোনাকালে ছুটিতে এসে আর যেতে পারেননি। চলতি বছরের গত ১০ মাসে এমন প্রায় তিন লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। এদের কারও কারও বিদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও এদের একটা বড় অংশ দেশে কর্মহীন হয়ে চরম অর্থ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। যোগ্যতা অনুযায়ী এসব প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবস্থিত প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ সময়ের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত অভিবাসী কর্মীদের দেশে ফেরার হার প্রায় ছয়গুণ বেশি। করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর গত ১ এপ্রিল থেকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন ২ লাখ ৭২ হাজার ১৮৭ জন। এদের মধ্যে আউটপাস নিয়ে এসেছে ৩৬ হাজার ৭৮১ জন। আর পাসপোর্টধারী কর্মীর সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪০৪ জন। আর এদের মধ্যে ৩১ হাজার ৩৩ জনই রয়েছেন নারী। এ বিশাল সংখ্যক ফিরে আসার বিপরীতে বিদেশ যেতে পেরেছেন মাত্র ১ লাখ ৮০ হাজার জন।

সূত্র অনুযায়ী,  এ পর্যন্ত যে সংখ্যক কর্মী দেশে ফিরেছেন তাদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরার সংখ্যা বেশি। এরমধ্যে সৌদি আরব এসেছে সবচেয়ে বেশি কর্মী। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছে ৭৬ হাজার ৯২২ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছেন ৭১ হাজার ৯০৩ জন, কাতার থেকে ২৯ হাজার ৬৫৫ জন, ওমান থেকে ১৬ হাজার ৯৫ জন এবং মালদ্বীপ থেকে ১৩ হাজার ২৪৪ জন, মালয়েশিয়া থেকে ১২ হাজার ৩৬৮ জন, কুয়েত থেকে ১১ হাজার ৯১২ জন, তুরস্ক থেকে ১০ হাজার ৪৫১ জন, ইরাক থেকে ১০ হাজার ১৬৯ জন, লেবানন থেকে ৭ হাজার ১৬৯ জন, সিঙ্গাপুর থেকে ৫ হাজার ৩১১ জন, জর্ডান থেকে ২২০৪ জন, বাহারাইন থেকে ২০২৩  জন, শ্রীলংকা থেকে ৫৫৪ জন, লিবিয়া থেকে ৪৫৫ জন, মরিশাস থেকে ৪৫২ জন, ইতালি থেকে ১৫১ জন,  ভিয়েতনাম থেকে ১২১ জন, দক্ষিন কোরিয়া থেকে ২২০ জন, লন্ডন থেকে ১৩৪ জন, কম্বোডিয়া থেকে ১০৬ জন, রাশিয়া থেকে ১০০ জন, থাইল্যান্ড থেকে ৮৯ জন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৭১ জন, নেপাল থেকে ৫৫ জন, মিয়ানমার থেকে ৩৯ জন, হংকং থেকে ১৬ জন, জাপান থেকে ৮ জনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আরো ১৪৬ জন ফিরে এসেছেন।

প্রবাসী কর্মীদের ফিরে আসার গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৬ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ৪১ হাজার ৬২৬ জন কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন, ২০১৭ সালে ফেরত এসেছেন ৫০ হাজার ১৬৩ জন, ২০১৮ সালে ফেরত এসেছেন ৬৮ হাজার ৮১২ জন,  ২০১৯ সালে ফেরত এসেছেন ৬৪ হাজার ৬৩৮ জন। আর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ফেরত এসেছেন ২ লাখ ৪২ হাজার ৮৭১ জন প্রবাসী কর্মী। এদের মধ্যে এপ্রিল থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে এসেছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৫২ জন।

মহামারি করোনার কারণে দেশে ফিরে আসা কর্মীদের এ দুরাবস্থার বিষয় কয়েকটি জরিপেও উঠে এসেছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের করা এ সংক্রান্ত জরিপ বলছে ফিরে আসা ৮৭ শতাংশ কর্মীর আয়ের উৎস নেই, আরেক বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট- রামরু’র জরিপ অনুযায়ী ৬১ শতাংশের আয় নেই। জরিপ পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। সেখানেও প্রবাসী কর্মীদের বেকারত্বের চিত্রই উঠে এসেছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি করোনার কারণে প্রবাসী কর্মী ফিরে আসার যে ঢল শুরু হয়েছে তা বছরের শেষে তিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, যারা বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন দেখতে হবে এদের মধ্যে কারা আবার যেতে চায়। তাদেরকে আরেকটু দক্ষ করে কীভাবে বিদেশ পাঠানো যায় সেটা চিহ্নিত করতে হবে। আর যে একটা বড় অংশ বিদেশ যেতে পারবে না তাদের দেশের ভেতরেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘এরা যেহেতু অন্যদের মত সব ধরনের কাজে দক্ষ না সেজন্য ছোট ব্যবসায় যুক্ত করা গেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। পরে তারা বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ পেলেও ওই ব্যবসা তাদের পরিবার চালিয়ে যেতে পারবে। সেখানে হতে পারে মাছের খামার, হাঁস-মুরগির খামার। যেসব এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি বাইরে যাচ্ছে তাদের কাছে যেতে হবে আমাদের যেতে হবে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে।’

এদিকে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের পুনর্বাসনে ৭ শ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে সরকার। কর্মীদের সহজশর্তে ঋণসুবিধা দিতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২ শ কোটি টাকা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ তহবিলে আরও পাঁচশ কোটি টাকা যোগ হচ্ছে।

এখান থেকে প্রবাসী পুনর্বাসন ঋণ নামে ৪ শতাংশ সরল সুদে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পাবেন প্রবাসীরা। প্রথম পর্যায়ে ঋণগ্রহিতাদের জন্য নানা শর্ত জুড়ে দেওয়ায় আবেদন কম আসে। পরে সেপ্টেম্বরে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়। এরপরেও আবেদনের সংখ্যা কম।

এ প্রসঙ্গে ঋণের জন্য আবেদনকারী প্রবাসী শ্রমিক লুৎফুর রহমান (৪০) জানান, ব্যাংকের সব শর্ত পূরণ করেও কাগজপত্র জমা দিয়েও ঋণ পাচ্ছেন না। এদিকে জমানো যে টাকা ছিল তা এরই মধ্যে শেষ। এখন কী উপায়ে অর্থ উপার্জন করবেন তা ভেবে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফিরে যাওয়ার সুযোগও তার জন্য সীমিত বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম- ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঋণ নেওয়ার আবেদন করার যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে প্রবাসীদের। তাদের ব্যবসা পরিকল্পনাও করতে পারে না। ঋণ গ্রহণের সহযোগিতা করার জায়গা নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা এখানে। যদিও এনজিওগুলো সেক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। সরকারও এ উদ্যোগ নিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘করোনার মধ্যে যারা ফিরে আসছে, তারা এক ধরনের মানসিক সমস্যায় রয়েছে। তারা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তিনি দেশে থাকবেন নাকি ফিরে যাবে। তাদের জন্য কাউন্সিলিং দরকার।’

এদিকে ফিরে আসা কর্মীদের সহায়তা দিতে গত অক্টোবর থেকে নিবন্ধন শুরু করেছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো। সেখানে ছুটিতে আসার পর নানা জটিলতায় ফিরে যেতে না পারা কর্মীদের নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। সে তালিকা অনুযায়ী কর্মীদের সহায়তা করার চিন্তা করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘করোনার কারণে শ্রমবাজারে তো একটা ধাক্কা লেগেছেই। তবে তা কাটিয়ে উঠতে নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যারা ফিরে এসেছে তাদের পুনর্বাসনে ৭ শ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। সেখান থেকে কর্মীরা সুবিধা পেতে শুরু করেছে। অন্যদিকে নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করার পাশাপাশি পুরনো শ্রম বাজার ধরে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

প্রবাসী প্রবাসী কর্মী বিদেশ ফেরত

বিজ্ঞাপন

চালু হলো পাঠাও পে
৮ জুলাই ২০২৫ ১৫:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর