নভেম্বরে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩২%, প্রাণহানি বেড়েছে ১৪%
৫ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৪০
সড়কে প্রাণহানি কমার নাম নেই। নভেম্বর মাসেও দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ৪১৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩৯ জন। গত অক্টোবর মাসের তুলনায় এ মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৩২ শতাংশেরও বেশি, আর প্রাণহানি বেড়েছে ১৪ শতাংশেরও বেশি। আর গত সেপ্টেম্বরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫২ শতাংশেরও বেশি। ওই মাসের তুলনায় নভেম্বরে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণহানিও বেড়েছে ৪৪ শতাংশের বেশি।
শনিবার (৫ ডিসেম্বর) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতাকে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফাউন্ডেশন দুর্ঘটনা রোধে ১০টি সুপারিশও করেছে।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বরের দুর্ঘটনা
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ২৭৩টি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩০৪ জন, আহত হয়েছিলেন ৪৯২ জন। অক্টোবর মাসে সারাদেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৪টিতে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৮৪ জন, আহত হয়েছেন ৬৯৪ জন। আর নভেম্বর মাসে দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪১৭, তাতে প্রাণহানি আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩৯ জনে। তবে নভেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা অক্টোবরের তুলনায় ১২ জন কম— ৬৮২ জন।
এই হিসাব অনুযায়ী অক্টোবর মাসের তুলনায় নভেম্বরে দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ, প্রাণহানি বেশি হয়েছে ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বর মাসের সঙ্গে তুলনা করলে নভেম্বরে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫২ দশমিক ৭৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
নভেম্বরের সড়ক দুর্ঘটনার খতিয়ান
নভেম্বরের সড়ক দুর্ঘটনাগুলোতে যে ৪৩৯ জন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৬৪ জন নারী, শিশু ৫৩টি। আর সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে এককভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। এ মাসে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৪১ জন, যা মোট নিহতের ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
এদিকে, দুর্ঘটনায় ১১৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছে ৪৯ জন, যা মোট নিহতের ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ। এই সময়ে চারটি নৌদুর্ঘটনায় তিন জন নিহত ও আট জন আহত হয়েছেন। আর ২৯টি রেলপথ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩২ জন, আহত সাত জন।
দুর্ঘটনায় ৩০ জন বাস যাত্রী, আট জন ট্রাক যাত্রী, ১১ জন পিকআপ যাত্রী, চার জন মাইক্রোবাস যাত্রী, ৯ জন অ্যাম্বুলেন্স যাত্রী, দুই জন ট্রলি যাত্রী, লরিতে থাকা তিন জন, ১২ জন সিএনজি যাত্রী, ৬২ জন ইজিবাইক-অটোরিকশা যাত্রী, ২৮ জন নসিমন-ভটভটি-টেম্পু যাত্রী, দু’জন বাইসাইকেল আরোহী, ছয় জন রিকশা-রিকশাভ্যানযাত্রী, দু’জন স্কুলভ্যান যাত্রী এবং তিন জন পাওয়ারটিলার-আলগামন যাত্রী নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার স্থান
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৭টি (৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ) দুর্ঘটনা ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে। এছাড়া গ্রামীণ সড়কে ১১৩টি (২৭ দশমিক ০৯ শতাংশ), জাতীয় মহাসড়কে ১১১টি (২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ), শহুরে সড়কে ৫১টি (১২ দশমিক ২৩ দশমিক) এবং অন্যান্য স্থানে (ফেরিঘাট, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ মাঠ ও ফসলের মাঠ) পাঁচটি (১ দশমিক ১৯ শতাংশ) দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার কারণ
দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২৬টি (৩০ দশমিক ২১ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়ার কারণে ঘটেছে। এছাড়া ১০৫টি (২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৯৭টি (২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৭৬টি (১৮ দশমিক ২২ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৩টি (৩ দশমিক ১১ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় দায়ী যানবাহন
দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়ী যানবাহনগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৬৪ শতাংশ থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-স্কুটার)। এছাড়া ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ, নসিমন-ভটভটি-আলগামন-পাখিভ্যান ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ, রিকশা-ভ্যান-বাইসাইকেল ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেট কার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং অন্যান্য (গ্যাসবাহী গাড়ি, গ্রামবাংলা, লাটাহাম্বা, ভ্যানগাড়ি) ১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহন
নভেম্বর মাসের ৪১৭টি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা ৬৮৯টি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫৬টি ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-স্কুটার। এছাড়া মোটরসাইকেল ১৩৬টি, ট্রাক ১০৩টি, বাস ৮২টি, নসিমন-ভটভটি-আলগামন-পাখিভ্যান ৬৩টি, রিকশা-রিকশাভ্যান-স্কুলভ্যান ৩১টি, পিকআপ ২৩টি, কাভার্ড ভ্যান ১৮টি, ট্রলি ১৬টি, মাইক্রোবাস ১৪টি, ট্রাক্টর ৯টি, প্রাইভেটকার ৯টি, লরি সাতটি, অ্যাম্বুলেন্স ছয়টি, বাইসাইকেল তিনটি, জিপ দুইটি, গ্যাসবাহী গাড়ি দুইটি এবং পাওয়ারটিলার-গ্রামবাংলা-লাটাহাম্বা-ভ্যানগাড়ি রয়েছে ৯টি।
দুর্ঘটনার সময় ও বিভাগ
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ভোরে ঘটেছে ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ, সকালে ৩৩ দশমিক ০৯ শতাংশ, দুপুরে ১৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, বিকেলে ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং রাতে ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। এই বিভাগে ১১১টি দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১২৮ জন। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ২২টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ জন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। এই জেলায় ২৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৩ জন। সবচেয়ে কম ভোলা জেলায় তিনটি দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন নভেম্বরে।
দুর্ঘটনার কারণ ও দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতাকে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এছাড়া অন্য যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি।
দুর্ঘটনা রোধে ১০টি সুপারিশও করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে— দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌপথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় মহাসড়কে সবসময় দুর্ঘটনার হার বেশি থাকলেও নভেম্বর মাসে জাতীয় মহাসড়কের তুলনায় আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়কে দুর্ঘটনার হার বেড়েছে। মোটরসাইকেলের চালক ও পথচারী নিহতের ঘটনা চরমভাবে বেড়েছে। রেল ক্রসিংয়ে চারটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে এই নভেম্বর মাসে। এসব দুর্ঘটনা রোধ করতে রেল ক্রসিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সড়ক-সেতু নির্মাণে আগ্রহ দেখা গেলেও সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সরকারের আগ্রহ তেমন দৃশ্যমান নয় বলে অভিযোগ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের। সরকারকে এ ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফাউন্ডেশন বলছে, মূলত সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ এবং গণপরিবহন খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা— উভয়ই জরুরি। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
আঞ্চলিক সড়ক জাতীয় মহাসড়ক নভেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনা মোটরসাইকেল রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সড়ক দুর্ঘটনা