একটি থাকার পরও কোটি টাকায় হচ্ছে টেলিটকের নতুন অ্যাপ!
৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৭ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০৫
ঢাকা: ‘মাই টেলিটক’ নামে অ্যাপ থাকার পরেও কোটি টাকা ব্যয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব মোবাইলফোন কোম্পানি টেলিটকের নতুন আরেকটি অ্যাপ তৈরি করছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। বর্তমানে চলমান অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড ভার্সনের। আর নতুন করে যে অ্যাপটি নির্মাণ হচ্ছে সেটিও আইফোন থেকে ব্যবহার উপযোগী নয়। প্রায় দুই বছর আগে সরকারের কাছে অ্যাপ তৈরির চাহিদাপত্র দিয়েছিল টেলিটক। কিন্তু বিলম্বিত হওয়ায় পরে নিজেরাই অ্যাপ তৈরি করে নিয়েছে। এতে ১০ লাখ টাকার কিছু বেশি খরচ হয়। এদিকে গুঞ্জন রয়েছে, টেলিটক চলমান অ্যাপটি নিয়েই সন্তুষ্ট। তারা নতুন এই অ্যাপটি নিতে চাচ্ছে না। ফলে সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, আইসিটি বিভাগের ‘মোবাইল গেইম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প থেকে এই অ্যাপটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি এক কোটি টাকায় রিভ সিস্টেম লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। দুই বছর আগের চাহিদা এবং প্রায় একই রকম অ্যাপ থাকায় নতুন অ্যাপটি না নেওয়ার ব্যাপারে টেলিটকের অভ্যন্তরে জোর গুঞ্জন রয়েছে।
নতুন এই অ্যাপটি নিতে টেলিটকের অনাগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করেছেন আইসিটি বিভাগের মোবাইল গেইম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (উপ-সচিব) মো. আনোয়ারুল ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘টেলিটকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা আমাকে ফোন করেছিলেন। অলমোস্ট তাদের এই অ্যাপ রয়েছে। এই অ্যাপটির জন্য প্রায় দুই বছর আগে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছিল। এখন যে অ্যাপটি হচ্ছে সেটার খরচ বহন করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হবে বলে তারা জানিয়েছেন। কাজটি এখন যে পর্যায়ে আছে সেখান থেকে পিছু হটার রাস্তার খুব একটা দেখছি না। তাদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি।’
জানতে চাইলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ( এমডি) মো. সাহাব উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘টেলিটকের পক্ষ থেকে এটুআইয়ের কাছে একটি অ্যাপের চাহিদা জানানো হয়েছিল। সেটি অনেক আগের কথা। এর মধ্যে আমরা নিজেরাই একটি অ্যাপ তৈরি করে নিয়েছি। আর আইসিটি বিভাগের পক্ষ থেকে সম্প্রতি রিভ সিস্টেমকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা এই অ্যাপটি নেওয়ার ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। অনেকেই বলছেন, এই অ্যাপটি আগের চেয়ে উন্নত হবে। অ্যাপটির বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টেলিটকের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং অ্যান্ড ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস) প্রভাস চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক আগে আমাদের একটি চাহিদা ছিল। পরে আমরা ইন হাউজ অ্যাপ ডেভেলপ করে নিয়েছি। এখন রিভ সিস্টেমের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। চাহিদা ছিল প্রায় দুই বা আড়াই বছর আগে।‘ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় এখন যে অ্যাপ তারা দিচ্ছে সেটা হয়তো আরও আপগ্রেডেড থাকবে। ভালো ফিচার থাকবে। যেহেতু এটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে, সেহেতু অ্যাপটি নিলে ইউজারদের সুবিধা হবে। যারা কাজ পেয়েছে তারা হয়তো আমাদের আইটি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমরাও একটি চিঠি পেয়েছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেলিটকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সরকারি অর্থ অপচয় করে নতুন এই অ্যাপটি নেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই রাজি নন। পরোক্ষ একটি চাপে ডাক ও টেলিযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত টেলিটক সরকারের আইসিটি বিভাগকে সরাসরি চিঠি দিতে পারছে না। মৌখিকভাবে মোবাইল গেইম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আর বিষয়টি নিয়ে টেলিটকের এমডি ডাক ও টেলিযোগযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে কথা বলতে চান।
প্রকল্পটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অ্যাপটিতে ব্যবহারকারীর দিক থেকে তিনটি অংশ থাকবে- সার্ভিস রিসিপিয়েন্ট, সার্ভিস অপারেটর ও সার্ভিস অবজারভার। আর অ্যাপটিতে থাকবে ছয়টি মডিউল। সেগুলো হলো- ইনফো সার্ভিস, অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, কাস্টমার কমপ্ল্যাইন, সিম রিকোয়েস্ট ম্যানেজম্যান্ট, রিচার্জ অ্যান্ড ভ্যাস সার্ভিস ও সিস্টেম ম্যানেজম্যান্ট। ১২ মাসে এই অ্যাপটি তৈরি হওয়ার কথা। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান তিন বছর এর দেখভাল ও সাপোর্ট সার্ভিস দিয়ে যাবে। একসঙ্গে পাঁচ হাজার ব্যবহারকারী অ্যাপটি ব্যবহার করতে পারবে। তিন সেকেন্ডে অ্যাপটি ওপেন হবে এবং টু জি নেটওয়ার্কেও অ্যাপটি কাজ করবে। এছাড়া ওয়েবসাইটের ব্যাকসাইটে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন থাকবে।
সম্প্রতি প্রকল্পে যোগ দেওয়ায় কোটি টাকা ব্যয়ে অ্যাপ নির্মাণের বাজেটের বিষয়ে ব্যখ্যা দিতে পারেননি প্রকল্প পরিচালক। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এর বাজেট তৈরি করেছিল এটুআই। সবকিছু দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ীই হয়েছে। সম্প্রতি রিভ সিস্টেমের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে।’ আর প্রকল্পের সাবেক একজন কর্মকর্তা জানান, ‘সম্পূর্ণ বিধিবিধান মেনেই প্রকিউরমেন্ট করা হয়েছে।’ এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান রিভ সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রথমে মেইল করে প্রশ্ন পাঠানোর কথা বললেও পরে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে মন্তব্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়।
অ্যাপের খরচ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীম আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই অ্যাপে যেসব স্পেশিফিকেশনের কথা বলা হচ্ছে তাতে মনে হয়, খরচ খুব বেশি হচ্ছে। আবার অ্যাপ তৈরি করলে মেইনটেন্সের বিষয়টি যদি অন্তর্ভুক্ত থাকে তাহলেও খরচ বাড়ে। তবে সবদিক বিবেচনায় খরচ একটু বেশিই মনে হচ্ছে।’
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক দিনের পুরোনো চাহিদাপত্র থাকলে অ্যাপ তৈরি বা কাজের ক্ষেত্রে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কিংবা যেটা আছে (অ্যাপ), সেটাকে আরও ডেভেলপ করতে হবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি একটি অ্যাপ থাকে তবে নতুন করে আরেকটি তৈরি করা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। বিদ্যমান অ্যাপটি কী তবে আপগ্রেড করা যাচ্ছে না? যেই সফটওয়্যার বা অ্যাপই তৈরি করা হোক না কেন সেটা যেন আগামী পাঁচ বছরের চিন্তা মাথায় রেখে করা হয়।’
এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি থাকার পরেও নতুন করে অ্যাপ তৈরি করার কোনো মানে নেই। যাদের প্রয়োজন, যাদের চাহিদা আছে, আমরা তাদের অ্যাপ তৈরি করে দিচ্ছি। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের যদি অ্যাপ থাকে, কিংবা নিতে না চায়, তাহলে তো অ্যাপ তৈরি করে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তারা যদি না চায় তাহলে এই কাজ (অ্যাপ তৈরি) বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘টেলিটক রিকোয়েস্ট করেছিল দুই বছরের বেশি সময় হয়েছে। দেরি করতে করতে প্রায় তিন বছর শেষ করে ফেলেছে। এর মধ্যে টেলিটক নিজেরাই মাই টেলিটক নামে একটি অ্যাপ তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু এতদিন পরে কেন অ্যাপ তৈরি হবে? অদৌ টেলিটকের সেই অ্যাপের প্রয়োজন আছে কি-না সেটা ভাবতে হবে।’
অ্যাপ আইসিটি বিভাগ জুনাইদ আহমেদ পলক মাই টেলিটক মোস্তাফা জব্বার রিভ সিস্টেম