Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নদীর গভীরতা-খরস্রোত— সব চ্যালেঞ্জ উৎরেই পদ্মাসেতু


১০ ডিসেম্বর ২০২০ ১৩:২৮

পদ্মাসেতু। ফাইল ছবি

ঢাকা: ভূমিকম্প, মাটির ক্ষয়সহ যেকোনো আঘাত প্রতিরোধ করে ঠিকে থাকবে পদ্মাসেতু। সব ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে ১০০ বছর ঠিকে থাকার শক্তি থাকছে পদ্মাসেতুর। আর সেই সক্ষমতা গড়ে তোলার উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মাসেতুর অবকাঠামো।

বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) শেষ স্প্যান বসানোর পর পুরো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নিয়ে পদ্মাসেতু এখন দৃশ্যমান। পূর্ণাঙ্গ পদ্মাসেতুতে এখন বাকি শুধু সড়ক ও রেলপথ স্থাপনের কাজ। সরকারের লক্ষ্য, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এই সেতু চালু করে দেওয়া।

দক্ষিণাঞ্চলকে বাকি দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করার এই যে মহাযজ্ঞ, সেই মহাযজ্ঞটি খুব সহজ কিছু ছিল না। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই অবকাঠামো গড়তে ছিল বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। প্রকৌশলগত সব চ্যালেঞ্জ জয় করেই শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয় এই সেতু। আর স্বপ্নের এই সেতুটি যেন যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হয় এর নকশায়।

আরও পড়ুন-

পদ্মাসেতু যেন ভূমিকম্প ও মাটির ক্ষয়সহ যেকোনো ধরনের ঘাত প্রতিরোধী হয়, সেজন্য বাঁকা করে নদীর তলদেশে নিয়ে গাঁথা হয়েছে খুঁটি। আর গাড়ি ও মালবাহী দ্বিতল রেলের ভার বহনে সক্ষম করার জন্য এই খুঁটিগুলো পুঁতে দেওয়া হয়েছে নদীর ৪২০ ফুট গভীরে। এই গভীরতা একটি ৪২ তলা ভবনের সমান!

পদ্মাসেতু সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের তথ্য, পদ্মার উপরিতল থেকে নদীর তল পর্যন্ত গভীরতা প্রায় ১৩০ ফুট। আর পানির তোড়ে নদীর তল থেকে মুহূর্তেই যে পরিমাণ মাটি সরে যায়, তা ২০০ ফুটেরও বেশি গভীর খাদ তৈরি করে। অর্থাৎ সেতুর খুঁটি স্থাপন করতে হলে তা কমপক্ষে ৩৩০ ফুট বা ৩৩ তলা ভবনের সমান উচ্চতার খুঁটি হতে হবে। সেতুর চূড়ান্ত নকশায় খুঁটিগুলো স্থাপন করা হয়েছে এর চেয়েও ৯০ ফুট বেশি, মোট ৪২০ ফুট গভীরতায়।

পদ্মাসেতুর প্রকৌশলগত জটিলতা নিরসনে বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। আমৃত্যু সেই প্যানেলের প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। পদ্মার প্রকৌশলগত জটিলতাগুলো নিয়ে একাধিকবার তার সঙ্গে কথা হয়েছিল সারাবাংলার।

ড. জামিলুরের দেওয়া তথ্য— পানি প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজানের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী বলা যায় পদ্মাকে। সেকেন্ডে ১৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয় এই নদীকে।

সেতুর নকশা প্রণয়ণের সময় এই বিষয়টিকে মাথায় রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন ড. জামিলুর। তিনি বলেছিলেন, একশ বছরে পদ্মায় কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হতে পারে, সেই হিসাবটি বিবেচনা করা হয়েছে। দেখা গেছে, মাত্র ২০ সেকেন্ড যে পরিমাণ পানি পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা দিয়ে পুরো ঢাকা শহরের সব মানুষের একদিনের পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

ব-দ্বীপ বাংলাদেশের গঠনগত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকা পলি মাটির। হিমালয় থেকে শুরু করে মাটি ক্ষয় হতে হতে পানির সঙ্গে মিশে সেটা বসে গিয়ে গঠিত হয়েছে এই ব-দ্বীপ। ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা, ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশ এখনো নতুন, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘ইয়াং ডেল্টা’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত সেতু নির্মিত হয়েছে বা এখনো নির্মাণ কাজ চলছে, তার মধ্যে পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজটি কারিগরি দিক থেকে অন্যতম জটিল একটি কাজ। এর পেছনে তারা মূলত দুইটি কারণ চিহ্নিত করেছেন— প্রথমত, নদীর নির্মানাধীণ স্থানে পরিবর্তনশীল গতিপথ নিয়ন্ত্রণ; দ্বিতীয়ত, নদীর তলদেশের স্তর ভবিষ্যতে আরও নিয়ে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, পদ্মাসেতু বিশ্বের অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি সেতু। এর কারণ তলদেশের গভীরতা। পদ্মা নদীর ১০ কিলোমিটার নিচে গিয়ে পাথরের স্তর। বিশ্বের অন্য কোনো নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে পাথরের স্তর পেতে এত নিচে যেতে হয় না।

শেষ পর্যন্ত ৪২০ ফুট গভীরতায় খুঁটি স্থাপন করতে গিয়ে বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল হ্যামার। কারণ এরকম খরস্রোতা নদীর এত গভীরে পাইলিংয়ের জন্য যে বিশালাকৃতির হ্যামার প্রয়োজন, বাস্তবে এরকম কোনো হ্যামারের অস্তিত্বই ছিল না। শেষ পর্যন্ত জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানি থেকে বিশেষ অর্ডার দিয়ে আনা হয়েছিল এই হ্যামার। এত শক্তিশালী হ্যামার পৃথিবীর আর কোথাও কখনো ব্যবহৃত হয়নি।

প্রকৌশলীদের ভাষ্য, পদ্মাসেতুর কাঠামোকে অসম্ভব শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে। কারণ পদ্মা নদীর যে পরিবর্তনশীল চরিত্র, তা যেন এই সেতুকে কোনোভাবেই টলাতে না পারে। তাছাড়া পদ্মাসেতুর ধারণক্ষমতাও অনেক বেশি করা হচ্ছে। কারণ এর ওপর কেবল চার লেনের সড়ক পথ নয়, থাকছে রেলপথও।

সব মিলিয়েই পদ্মার গভীরতা আর খরস্রোত বারবার পদ্মাসেতুর অবকাঠামো নকশায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে। তবে একাগ্রচিত্তে সেসব সমস্যার সমাধানও বের করে নিয়ে এসেছেন প্রকৌশলীরা। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পদ্মাসেতু ৪১টি স্প্যান নিয়ে পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান গোটা বিশ্বের সামনে। সড়ক আর রেলপথ স্থাপনের কাজ শেষ হলেই বছরখানেকের মধ্যে সেই সেতুটি হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম কোলাহলমুখর পথ— সেই স্বপ্নই এখন মানুষের মনে।

খরস্রোত গভীরতা ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মা নদী পদ্মাসেতু


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর