রিভিউয়ে ঝুলে আছে আলোচিত ৩ মামলা
১২ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৭
ঢাকা: দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আলোচিত প্রায় দেড় ডজন মামলা ঝুলে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রিভিউ পর্যায়ে পৌঁছেও গিয়ে বিচারের সমাপ্তি ঘটছে না। এর মধ্যে অন্যতম তিনটি মামলা হলো: ১. জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা ২. ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ ঘোষণার মামলা এবং ৩. জেলা জজদের পদমর্যাদা নির্ধারণের মামলা।
এটিএম আজহারের মৃত্যদণ্ডের রিভিউ শুনানি: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম গত ১৯ জুলাই আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেন। এর ফলে বিচারিক আদালতে দেওয়া রায়ের ছয় বছর পরেও বিচার সমাপ্তি হলো না। এখনও রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও দুটি ধাপ রয়ে গেছে। এর একটি হলো রিভিউয়ের রায়। অপরটি হলো রাষ্টপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ।
এর আগে, গত ১৯ জুলাই জামায়াত নেতার মৃত্যদণ্ডের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন ভার্চুয়াল আপিল বিভাগের নজরে আনেন (মেনশন করা) রাষ্টপক্ষ। তখন আদালত জানায়, এটিএম আজহারুল ইসলামের রিভিউ শুনানি ভার্চুয়াল কোর্টে হবে না। নিয়মিত আদালত চালু হলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই মামলার রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি হবে। যদিও বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সকল মামলার শুনানি ভার্চুয়ালি হচ্ছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আজহার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন।
পরে আজহারুল ইসলামের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। পরে গত ১৫ মার্চ এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। এর পরদিন ১৬ মার্চ তার মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর রিভিউ আবেদন করেন আজহার।
এ বিষয়ে এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী শিশির মনির সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেছি। পরে রাষ্টপক্ষ এটি ভার্চুয়াল কোর্টে মেনশন (নজরে আনা) করে। তখন আদালত জানায় এ মামলার রিভিউ শুনানি ভার্চুয়াল কোর্টে নয়, নিয়মিত কোর্টে হবে। অর্থ্যাৎ নিয়মিত আদালত চালু হলে এ মামলার রিভিউ শুনানি হবে।’
ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ ঘোষণার আপিল নিষ্পত্তিতে দফায় দফায় সময় বৃদ্ধি: এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ৯টি ধারাকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৭ সালের ১১ মে রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। রায়ে ২০০৯ সালে পাস হওয়া এ আইনকে সংবিধান পরিপন্থি ও এখতিয়ার বহির্ভূত হিসেবে ঘোষণা করে আদালত। তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়ার এ বিধানকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা পৃথকীকরণের মতো দুটি মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করেছে বলে ওই রায়ে বলা হয়।
একইসঙ্গে হাইকোর্ট ওই রায়ে অভিমত দেয় যে, সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা কোনো অবস্থাতেই বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এরপর আপিল নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তি দেখিয়ে দফায় দফায় এ স্থগিতাদেশ বাড়িয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী হাসান এমএস আজিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার বারবার আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে দেখিয়ে সময় বাড়িয়ে নিচ্ছে। এতে রায়ের কার্যকারিতা বন্ধ থাকছে না। আর এতে সাধারণ মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মামলার আপিল শুনানি দ্রুত শুরু করা উচিত। অন্যথায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের এ আইনের প্রয়োগ বন্ধ রাখা উচিত।’
এ আইনের বড় ত্রুটি হলো যার বিরুদ্ধে মামলা অর্থ্যাৎ যিনি আসামি তিনিই সাক্ষী। এটি হতে পারে না বলে মনে করেন রিটকারী এ আইনজীবী।
জজদের পদমর্যাদার রিভিউ শুনানি পড়ে আছে তিনবছর: রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) চ্যালেঞ্জ করে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পক্ষ থেকে করা রিট মামলাটি ১৪ বছর ধরে ঝুলে আছে সর্বোচ্চ আদালতে।
সরকারের কার্যপ্রণালি বিধি (রুলস অব বিজনেস) অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০০০ সালে সরকার এটি সংশোধন করে। সংশোধিত এ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব আতাউর রহমান। ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জেলা জজদের পদমর্যাদা নির্বাহী বিভাগের সচিবদের পদমর্যাদার সমমান মর্যাদা দিয়ে রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। রায়ে পূর্বের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বাতিল করে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে এটি নতুনভাবে তৈরি করতে বলা হয়।
এ রায় বাস্তবায়ন করলে প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এমন দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি এ বিষয়ে রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপক্ষ রায়টি পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে। যা এখনও বিচারাধীন রয়েছে।
এ মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে জেলা জজদের মধ্যে পদমর্যাদা নিয়ে দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য রিভিউ আবেদনটি জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিচারসংশ্লিষ্টরা।
জেলা জজদের পদমর্যাদার সংক্রান্ত এ মামলার বিষয়় কয়েক দফা চেষ্টা করেও বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এই রায়ের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করেছি। যা এখন শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছে।’