পদ্মার ভাঙনে বিলীনের পথে সীমান্তবর্তী শেষ গ্রাম
১৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০৯:০৬
রাজশাহী পদ্মার চর খানপুর থেকে: রাজশাহীর সীমান্তবর্তী একমাত্র গ্রাম চর খানপুর। এখানে এখন প্রায় দুই হাজার লোকের বসবাস। এই গ্রামের বাসিন্দারা গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল লালনপালন ও শাকসবজি আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যদিও এর আগে খানপুরে কোনো বসতি ছিল না। পদ্মার স্রোতে ভাঙনের ফলে চর খিদিরপুর গ্রামের বাসিন্দাদের একটি অংশ খানপুরে এসে বসতি স্থাপন করেছে। খিদিরপুর এখন শুধুই ধু ধু বালু চর।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এই গ্রামের বাংলাদেশ অংশে থাকা বেশিরভাগ অংশ এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। যেটুকু রয়েছে সেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের অংশ। বর্তমানে খালি পরে আছে প্রায় ৪০/৫০ একর পতিত জমি। শীতকালের এই সময়ে পদ্মার অনেক স্থানে হাঁটু পানি। গ্রামবাসীর আশঙ্কা, আগামী বর্ষা মৌসুমে এই গ্রাম থাকবে কি নাকি বিলীন হবে? বিলীন হলে দক্ষিণে যাওয়া আর সম্ভব না। কারণ ভারতের একেবারে কিনারে বাস করছেন তারা। কোথাও কোথাও ভাঙন ভারতের অংশেও ঢুকে পড়েছে।
খিদিরপুরে ছিল বিজিবি ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পটিও এখন খানপুরে অবস্থিত। খানপুরে খিদিরপুর বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার মানিক দেবনাথ আশঙ্কা জানিয়ে বলেন, ‘আমরাও ভয়ে আছি আগামী বছর বর্ষায় এই ক্যাম্প থাকবে কিনা? খানপুরের এই ভিটেটুকু ভাঙলে নতুন ক্যাম্প করার জায়গাও থাকবে না।’
স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল নদীর চর দেখিয়ে বলেন, ‘বছর পাঁচেক আগেও ওখানে পাকা দালান ছিল। ছিল তিন তলা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দোতালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি হাইস্কুল, মাদ্রাসাসহ আরও কত কি। বসতি ছিল হাজার ত্রিশেক মানুষের। পাকা দালানের বাড়িও ছিল অনেকের। মাঠে ধানের আবাদ থেকে শুরু করে শীতকালীন সবজির চাষ হত। বাথান ছিল কয়েকটি। প্রতি বর্ষায় উত্তাল পদ্মায় একে একে ভাঙতে ভাঙতে গত বছর খিদিরপুরের শেষ চিহ্নটুকু সীমান্ত পিলারও নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে শীতকালে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় খিদিরপুরে চর দেখা মিলেছে। সেখানে আমার ৪০ বিঘা ধানি জমি ছিল, ছিল পাকা বাড়ি। সর্বস্বান্ত হয়ে আজ খানপুরে অন্যের জমিতে কুঁড়েঘর তুলে বসবাস করছি। ভাঙনের যে পরিস্থিতি তাতে আগামী বর্ষা মৌসুমে খানপুর গ্রামের টিকে থাকা বসতবাড়িগুলোও বিলীন হয়ে যাবে।’
রাজশাহী শহরের পদ্মা নদীর তীর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরসংলগ্ন এলাকায় খিদিরপুর ও খানপুর গ্রাম অবস্থিত।
শামীম নামে স্থানীয় একজন বলেন, ‘আমরা চাষাবাদ করে যে সবজি বাজারে নিয়ে যাই, লাভের বেশি অংশ চলে যায় নৌকা বা ট্রলার ভাড়ায়। এই গ্রাম থেকে রাজশাহী শহরে যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। আর শীত মৌসুমে আরও সময় বেশি লাগে। পদ্মার এক অংশ ভারতের কাতলামারি গ্রামে পড়ে যাওয়ায় আধা ঘণ্টার পথ যেতে হয় তিন ঘণ্টায়। মাত্র ৪ কিলোমিটার পথ যেতে ঘুরে যেতে হয় ১৭ কিলোমিটারের বেশি পথ। এখানে যাতায়াতের ব্যবস্থা ঠিক থাকলে শহরে যাওয়ার সময়টা সহজ হয়।’
আবদুল মান্নান বলেন, ‘সরকার যদি বেড়িবাঁধ করে দিত তাইলে এত ভাঙনের কবলে পড়তে হতো না। আমরা চাই আমাদের ভিটেমাটি টিকিয়ে রাখতে। আমরা চাই না এই ভূমি বিলীন হয়ে ভারতের দিকে চলে যাক। বর্ষাকালে যে পরিমাণ ভাঙন ধরে তাতে খুব বেশি সময় লাগবে না বিলীন হতে। এই সরকার আগে প্রায় ২ হাজার ৫০০ ঘর দিয়েছিল। ওই ঘর, ওই বাড়ি সব বিলীন হয়ে যায়। অনেক কষ্টে আমরা বেঁচে আছি।’
লিখন নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানের শিক্ষা ব্যবস্থাও খুব নাজুক। মাত্র একটি প্রাইমারি স্কুল আর একটা হাইস্কুল। তাও শিক্ষকের এখন নিয়মিত আসতে পারেন না। তারা শহর থেকে আসে, এক-দুই ঘণ্টা পরই চলে যান, আবার অনেকেই আসতে চান না এখানে।’ প্রাইমারিতে ৮ জন শিক্ষক থাকলেও অনিয়মিত ভাবে আসেন তারা।
মতিয়ার রহমান (৫৫) জানান, কৃষক হিসেবে আমরা ধান, মসুর ডাল, কালাই চাষ করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করছি। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি তারা কৃষিকাজে সময় দেই। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোরকম জীবন চালিয়ে যাই। সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। এখানে কোনো সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নাই। কেউ রোগে আক্রান্ত হলে রাজশাহী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর আবাদি জমি অনেকখানি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিবছর এভাবে ভাঙন ধরলে এই গ্রাম আর পরের বছর থাকবে না। পদ্মায় বিলীন হয়ে যাবে। প্রতিবছর বন্যায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি উঠে। এরপর শুরু হয় ভাঙন। গত ১৫/১৬ বছরে পুরো গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। ওই সময় এই গ্রামে মানুষ ছিল প্রায় ২০ হাজার। এখন দুই হাজারেরও কম মানুষ বসবাস করি। এরমধ্যে প্রায় সব আবাদি জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে।’