অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে সীমান্তে হত্যা ঘটছে: দোরাইস্বামী
২০ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:২৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: হত্যা বন্ধে সীমান্তে বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। তার মতে, অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অনুপ্রবেশের কারণে সীমান্ত হত্যা ঘটছে।
রোববার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেছেন।
সভায় সীমান্ত হত্যা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা নিয়ে আমরা বাংলাদেশীদের উদ্বেগের বিষয়ে অবগত। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভারতের কেউ এ ধরনের একটি মৃত্যুও চায় না। আমরা শান্তিপূর্ণ সীমান্ত চাই, সেটির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যেই সীমান্তে বৈধ বাণিজ্য বাড়াতে সীমান্ত হাটসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একজনও হতাহত হোক সেটি আমরা চাই না। আমরা আপনাদের সবচেয়ে নিকটের প্রতিবেশি, আমরা কেন আপনাদের অনুভূতিতে আঘাত দেব? এটা আমাদের অভিপ্রায় নয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ ধরনের ঘটনা কেবল আত্মরক্ষার্থে ঘটছে। তারা সীমান্তের এপারে (বাংলাদেশ) কখনো গুলি করে না। দুই পাশেই একই মানুষ, সীমান্তে কে কোন দেশি তা পৃথক করা কঠিন।’
‘সমস্যা হলো, সীমান্তে দুর্ঘটনার ৮৭ শতাংশ হয় রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে। আর ৯০ শতাংশ আমাদের সাইডে (ভারতে)। এটি এমন নয় যে কেবল বাংলাদেশীরাই দুঃখজনকভাবে আহত হচ্ছে। বিএসএফসহ বহু ভারতীয়ও কিন্তু আহত হচ্ছে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। মানুষ তার অর্থনৈতিক চাহিদা থেকেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এই অবস্থায় সীমান্তে যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন এ ধরনের ঘটনা বন্ধে এবং লোকদের অবৈধ যাতায়াত বন্ধে, সব অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে।’
দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের পারস্পরিক গোয়েন্দা সহযোগিতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি দুই সীমান্তে অপরাধ কমাতে আরও অর্থনৈতিক উন্নয়ন দরকার। আমাদের জায়গা থেকে আমাদের পেট্রোল টিমে সাধারণত চারজনের বেশি থাকে না। একজনের বেশি কেউ অস্ত্র বহন করে না এবং এটি কেবল আত্মনিরাপত্তায় ব্যবহৃত হয়। এটি একটি মানবিক সমস্যা। এটিকে মানবিকভাবেই সমাধান করতে হবে।’
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে দোরাইস্বামী বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের উদারতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। আমাদের অবস্থান বাংলাদেশের মতোই। আমরা প্রত্যেকের নিরাপদ, দ্রুত এবং টেকসই প্রত্যাবাসন চাই। আমরা জানি এটা বাংলাদেশের জন্য কতটা কঠিন। আমরা প্রত্যাবাসনকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতায় প্রস্তুত। সবচেয়ে কার্যকরি হলো আগে সেখানে ইতিবাচক প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। সুতরাং আমরা রাখাইন প্রদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করতে বিনিয়োগ করছি। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করতে পেরে আমরা খুশি।’
‘আমরা মিয়ানমারকেও অনুরোধ করেছি যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়। মানুষ যাতে স্বাগ্রহে ফিরে যেতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের কোনো ভিন্ন অবস্থান নেই। সুতরাং যারাই বলুক ইন্ডিয়া এটি শুরু করতে চাচ্ছে না, এটা সত্য নয়। আমরা অবশ্যই চাই রোহিঙ্গারা ফিরে যাক। আমরা বুঝি বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ এ বিষয়ে, বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার জন্য। এটি কেবল বাংলাদেশিদের জন্য সমস্যা না, এটা ভারতেরও উদ্বেগের বিষয়। সুতরাং আমাদের সহানূভূতি যেমন আছে, একইসঙ্গে সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার যথার্থতাও রয়েছে’-বলেন দোরাইস্বামী।
সভায় বক্তব্যে বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ‘চট্টগ্রাম ৪ শ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের কাছে বাণিজ্যের গেটওয়ে। চট্টগ্রামের একটি সোনালী অতীত রয়েছে। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক দিক থেকে চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরও বেশি।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আলী আব্বাসের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জি, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাউদ্দিন রেজা বক্তব্য রাখেন। এসময় চট্টগ্রামের ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনারের কার্যালয়ের দ্বিতীয় সচিব শুভাশীষ সিনহাও উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সকালে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ মিলনায়তনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় অংশ নেন দোরাইস্বামী। মতবিনিময়ে তিনি সীমান্তে আইসিডি, ওয়্যারহাউস নির্মাণ, রেললাইন উন্নয়ন ও স্থলবন্দরের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মত দেন।
বক্তব্যে দোরাইস্বামী বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রমেই বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আর এর প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে চট্টগ্রাম। প্রতিবেশীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্কের ওপর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। সেবা ও উৎপাদন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বন্ধুত্বকে টেকসই করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য এমনকি ভুটান, নেপালও উপকৃত হতে পারে। আর এতে লাভবান হবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই।’
নির্মাণ ও চিকিৎসা সামগ্রী, ফার্মাসিউটিক্যালস ও এপিআই পার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা, বে-টার্মিনালে অর্থায়নসহ অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের আগ্রহ রয়েছে।’
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে এই মতবিনিময় সভায় চেম্বারের পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব, অঞ্জন শেখর দাশ, নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন ও সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বক্তব্য রাখেন।
চেম্বারে সভা শেষে বিক্রম দোরাইস্বামী নগরীর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে যান। অগ্নিযুগের বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতি বিজড়িত এই জাদুঘর তিনি ঘুরে দেখেন। এরপর প্রীতিলতার ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ইউরোপিয়ান ক্লাবে পৌঁছার পর নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) বিজয় কুমার বসাক তাকে স্বাগত জানান।