বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙবে না: দোরাইস্বামী
২২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:০৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী।
মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের মিত্রবাহিনীর যৌথ বীরত্বগাঁথার স্মৃতি সংরক্ষণে সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে।
দোরাইস্বামী বলেন, ‘এই স্মৃতিস্তম্ভ বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় যোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও আবেগের প্রতীক। আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি যে, সীতাকুণ্ডে নির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নয়, একইসঙ্গে ভারতের সেনা যোদ্ধাদেরও সম্মানিত করা হয়েছে। আমার বাবা নিজেও ফাইটার পাইলট ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। তাই আমি নিজে আরও বেশি গর্ববোধ করছি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব শুধু ইতিহাস-সংস্কৃতি ও ভৌগলিকভাবেই সম্পৃক্ত নয়। এই সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে রক্ত ও উৎসর্গের মাধ্যমে। এই সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ক। আমরা কখনো এটা ভুলে যেতে পারি না। প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে তৈরি এ সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙবে না। পদ্মা, মেঘনা নদী যতদিন বহমান থাকবে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও ততদিন থাকবে।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেতনার অপর নাম বঙ্গবন্ধু। এটিই বাংলাদেশের সারমর্ম এবং একে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। এটি বাংলাদেশের মানুষের দায়িত্ব। যে চেতনা এসেছে রক্ত থেকে, জীবন উৎসর্গ করার মধ্য থেকে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে এটিকে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। যারা বাংলাদেশের এই চেতনাকে দ্বিখণ্ডিত করতে চায়, তারা বাংলাদেশের বন্ধু নয়।’
‘আপনাদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে আপনাদের অতীতের ওপরই,’— বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে বলেন ভারতীয় এই কূটনীতিক।
দোরাইস্বামী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ শক্তিশালী, সমৃদ্ধশালী ও অগ্রগতিশীল একটি দেশ। বাংলাদেশ শুধু ভারতের বন্ধুই নয়, দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি মহান দেশ। আপনারা (বাংলাদেশের জনগণ) বিশ্বকে উদাহরণ দেবেন, বঙ্গবন্ধুর চেতনা নিয়ে কিভাবে একসঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়।’
একই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের সাব সেক্টর কমান্ডার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এই স্মৃতিস্তম্ভ করার কথা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। আমি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একজন সদস্য। আমি বারবার মন্ত্রণালয়কে বলি, গত মিটিংয়েও বলেছি। আমাদের ১১টা সেক্টর ছিল। ১১টা সেক্টরের ১১ জন কমান্ডার ছিলেন। এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিক সাহেব। আমি ছিলাম সাব সেক্টর কমান্ডার। আমি জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কোথায় কোথায় কি হয়েছে। আমি বলেছিলাম যে, এগুলোর স্মৃতি রক্ষা করার জন্য আপনারা উদ্যোগ নেন, গণকবরগুলো রক্ষা করার জন্য আপনারা উদ্যোগ নেন। যেসব স্থানে আমরা যুদ্ধ করেছি, এখনো আমরা জীবিত আছি, আমরা সেগুলো চিহ্নিত করব, আপনারা সেগুলোর স্মৃতি রক্ষা করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তারা এখনো সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।’
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। কিন্তু শুধু গেরিলা যুদ্ধ করে একটা দেশ স্বাধীন করা যায় না। ৩ ডিসেম্বর ভারতের মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মিলে যৌথভাবে যুদ্ধ শুরুর পর মাত্র ১৩ দিনের মাথায় আমরা বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। পৃথিবীর ইতিহাসে এত কম সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা পাবার নজির আর নেই। এটা সম্ভব হয়েছিল, একমাত্র ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতার কারণে।’
সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে যে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতের মিত্রবাহিনীর একই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে সেটা অনেকেই জানতেন না, এমনকি নতুন প্রজন্মের কেউ জানতোই না। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে জানার পর তথ্য সংগ্রহ করে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আজ আমার খুব ভালো লাগছে যে, এই ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ আমরা উদ্বোধন করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘এই স্মৃতিস্তম্ভ আমরা নির্মাণ করেছি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, মিত্রবাহিনী আমাদের কিভাবে সহযোগিতা করেছে, রক্ত দিয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে- সেই ইতিহাস তুলে ধরার জন্য। নতুন প্রজন্ম এটা দেখবে এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। তারা অনুধাবন করবে যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা এই দেশের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছে আর আজ আমাদের কি করা উচিৎ। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন প্রজন্মের কি করা উচিৎ এই জাগরণ তৈরি হবে। চট্টগ্রামে অনেকগুলো বধ্যভূমি আমরা সংরক্ষণ করছি, স্মৃতিস্তম্ভ করছি- এটা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্য। এই ইতিহাস জানলে তারা সুনাগরিক হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা তারা ধারণ করবে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল।
এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে এর উদ্বোধন করেন।
এসময় চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, মহানগর কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, ভারতীয় হাইকমিশনের সেকেন্ড অফিসার দীপ্তি আলংঘাট, ভারতীয় হাইকমিশনের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে নিযুক্ত সহকারী হাইকমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী ও সেকেন্ড সেক্রেটারি শুভাশীষ সিনহা উপস্থিত ছিলেন।