Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চালু হচ্ছে ‘গভীর সমুদ্রবন্দরে’র চ্যানেল, প্রথম জাহাজ ভিড়ছে কাল


২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ১১:০৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বঙ্গোপসাগরের তীরে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় নির্মিতব্য দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল চালু হতে যাচ্ছে। আগামী মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা একটি জাহাজ প্রথমবারের মতো এই চ্যানেল অতিক্রম করে গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায় মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মিত জেটিতে প্রবেশ করবে। এরই মধ্যে চ্যানেল দিয়ে নিরাপদে জাহাজ প্রবেশ করানোর সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

২০২৬ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালুর সময়সীমা নির্ধারিত আছে। তবে এর আগেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার মধ্য দিয়ে চালু হয়ে যাচ্ছে সমুদ্রবন্দরের চ্যানেলটি।

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে যুক্ত চট্টগ্রাম বন্দরের সহকারী হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন আতাউল হাকিম সারাবাংলাকে বলেন, ’মঙ্গলবার সকাল ১০টায় একটি জাহাজ প্রথমবারের মতো গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল অতিক্রম করে জেটিতে আনা হবে। জাহাজটি আসবে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মালামাল নিয়ে। মালামালগুলো জাপানি প্রতিষ্ঠানের হলেও সেগুলো তৈরি হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার একটি কারখানায়। সেজন্য জাহাজটি আসবে ইন্দোনেশিয়া থেকে।’

গভীর সাগরে জাহাজটি আসার পর চট্টগ্রাম বন্দরের পাইলটরাই সেটিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মিত জেটিতে নিয়ে আসবেন বলে ক্যাপ্টেন আতাউল হাকিম জানিয়েছেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য বঙ্গোপসাগেরে যে চ্যানেলটি তৈরি করা হয়েছে, সেটি ২৫০ মিটার চওড়া এবং ১৮ মিটার গভীর। জাহাজ চলাচলের পথনির্দেশনার জন্য এরই মধ্যে ছয়টি বয়া চ্যানেলে স্থাপন করা হয়েছে। আর মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মিত হয়েছে দু’টি জেটি।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ যুক্ত আছে দেশের প্রথম এই গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নে। মূলত কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে সেই পরিকল্পনা সংশোধন করে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বন্দর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চলতি বছরের (২০২০) ১০ মার্চ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন পায়।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ’ প্রকল্পে মোট খরচ হচ্ছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। ২৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণও এই ব্যয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। শুধু সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি সংস্থা জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সহজ শর্তে মাত্র শূন্য দশমিক এক শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। সরকার জোগান দিচ্ছে দুই হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন করবে দুই হাজার ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এরই মধ্যে জাপানের খরচে ‘গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ফিজিব্যালিটি ও প্রি-ফ্যাজিবিলিটি স্টাডি’ও সম্পন্ন করা হয়েছে। এরপর গত ২৩ সেপ্টেম্বর এই সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য জাপানের নিপ্পন কোই নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বে জাপানের আরও দু’টি এবং একটি দেশীয়সহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে— জাপান পোর্ট কনসালট্যান্ট, সিডিআই ও ডিডিসি। তাদের মাধ্যমে নকশা প্রণয়ন, সুপারভিশন, মনিটরিং, টেন্ডার অ্যাসিস্ট্যান্সসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হবে। তারা পূর্ণাঙ্গ নকশা জমা দেওয়ার পর ২০২১ সালের শেষেরদিকে টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালের শেষের দিকেই নির্মাণকাজ শুরুর সিদ্ধান্ত আছে। দুই ধাপে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কার্যক্রম চলবে। একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ হবে প্রথমে। এরপর চাহিদার ভিত্তিতে টার্মিনাল আরও বাড়ানো হবে। ২০২৬ সালে কাজ শেষে মাতারবাড়ি বন্দরে অপারেশন শুরু হবে। তবে এর আগে ২০২৫-এর মাঝামাঝিতেই টার্মিনালের কার্যক্রম ‍শুরু হতে পারে বলে ধারণা করছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।

তারা আরও জানিয়েছেন, গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চার লেনের ২৬ কিলোমিটার সড়কও নির্মাণ করা হবে। এই সড়ক যুক্ত হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে। ২০২৬ সালের মধ্যেই রোড নেটওয়ার্ক তৈরিও সম্পন্ন হবে, যা বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এছাড়া রেল নেটওয়ার্কেরও ফিজিবিলিটি স্টাডি হচ্ছে বলে বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেল দিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ও ১৯০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ বন্দরের জেটিতে ঢুকতে পারে। মোংলা বন্দরে তার চেয়েও কম, কারণ এখানে গভীরতা কম। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরে অন্তত ১৫ মিটার গভীরতা বা ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করতে পারবে। প্রতিটি জাহাজ আট হাজারের বেশি কনটেইনার নিয়ে জেটিতে ভিড়তে পারবে।’

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের আরও সম্ভাবনা দেখছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে এসে ফিরে যেতে ১৫ দিন লাগে, সেটা পাঁচ দিনের মধ্যেই অনায়াসে মাতারবাড়িতে চলে যেতে পারবে। তাহলে ব্যবসায়ীদের খরচ কম হবে এবং তারা আকৃষ্ট হবেন। আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই মাতারবাড়ি বন্দর। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক বেল্ট গড়ে উঠছে, তাতে এই বন্দর এই অঞ্চল তথা দেশের, বঙ্গোপসাগরে আমাদের অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আর আমাদের যে সুনীল অর্থনীতির কাজ শুরু হয়েছে, এই বন্দরের মাধ্যমে আরও বেগবান হবে।’

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জাফর আলম বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য একেবারে ক্লিয়ার— নিজের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিজেদের তৈরি করা, নিজের ইকোনমির জন্য এবং পার্শ্ববর্তী দেশকে সহায়তা করার জন্য এই বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চারটি কনটেইনার দিয়ে যে ট্রানজিট ভারতে চালু হয়েছে, এটি একেবারে প্রাথমিক ব্যাপার। মাতারবাড়ির জন্য আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে— আশপাশের ল্যান্ডলকড কান্ট্রিগুলো অথবা যে স্টেটগুলো আছে, সেগুলোকে নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের নিজের তাগিদেই তার ব্যবসা নির্ধারণ করবেন, দিকনির্দেশনা ঠিক করবেন। আমাদের কাজ হবে শুধু সুযোগটা সম্প্রসারণ করে দেওয়া।’

গভীর সমুদ্রবন্দর জাহাজ মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর