Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার


৩ জানুয়ারি ২০২১ ১২:০৮

ঢাকা: বিদায়ী ২০২০ সালের শুরু থেকেই পুঁজি হারানোর শঙ্কায় ভুগতে থাকেন বিনিয়োগকারীরা। এই শঙ্কায় নতুন মাত্রা যোগ করে গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত। তবে পুঁজিবাজারে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত টানা দরপতন চলতে থাকলেও আগস্টে তা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। শেষ পাঁচ মাসে অনেকটা টানা উত্থানের কারণে বছর শেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। বছর শেষ দিকে পুঁজিবাজার এতটাই ভালো অবস্থানে রয়েছে যে, ২০১০ সালের মহাধসের পর গত ১০ বছরে এর চেয়ে ভালো অবস্থান আর দেখা যায়নি। ফলে বিনিয়োগকারীরা ফুরফুরে মেজাজে ২০২০ সাল পার করলেন।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারে বিপর্যয়

২০২০ সালের শেষটা বিনিয়োগকারীদের জন্য আনন্দময় হলেও বছরের শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। বিদায়ী বছরের শুরুতে ৪ হাজার ৪৫২ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স। কিন্তু জানুয়ারি মাসের অর্ধেক না পেরোতেই অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারির মধ্যে ৪১৬ পয়েন্ট কমে ডিএসই‘র প্রধান সূচক নেমে আসে ৪ হাজার ৩৬ পয়েন্টে। একই সময়ে দৈনিক লেনদেন নেমে আসে দুইশ’ থেকে তিনশ’ কোটি টাকায়। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পরদিন ৯ মার্চ পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক হারায় ২৭৯ পয়েন্ট। এভাবে দরপতন অব্যাহত থাকায় ১৮ মার্চ ডিএসইর প্রধান সূচক নেমে আসে ৩ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে। ওইদিন সূচকটি ২০১৩ সালের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। এর আগে ২০১৩ সালের ৯ মে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৩ হাজার ৫৫৯ পয়েন্ট।

ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ টানা ৬৬দিন পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ

ডিএসইর প্রধান সূচক আগের সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসায় পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ১৯ মার্চ থেকে লেনদেনের সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়। সেইসঙ্গে প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস (দামের সর্বনিম্ন সীমা) নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে করে পতনের মাত্রা কমে আসে। এরই মধ্যে লকডাউন শুরু হলে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত  টানা ৬৬ দিন পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ রাখা হয়। লেনদেন বন্ধ থাকাকালীন গত ১৭ মে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এবং কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজারে লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ মে থেকে ফের লেনদেন চালু হয়।

বিজ্ঞাপন

বিএসইসির চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ায় পর ঘুরে দাড়ায় পুঁজিবাজার

পুঁজিবাজারের লেনদেন, সূচক, বাজার মূলধন এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে নেমে যাওয়ার মধ্যেই কমিশনের দায়িত্ব নেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের বার্তা দেন। এরপর দুই মাসের মধ্যেই একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মোটা অংকের জরিমানা করেন। সেইসঙ্গে বেশকিছু বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেন। বিএসইসির কর্মকর্তাদের দায়িত্বও রদবদল করা হয়। এসব পদক্ষেপের ফলে সুফল পেতে শুরু করে দেশের পুঁজিবাজার।

পুঁজিবাজার বাড়ছে বিনিয়োগকারী

দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে চলতি বছরের শেষ দিকে চাঙ্গা হয়ে উঠে পুঁজিবাজার। প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে আর্থিক ও শেয়ার লেনদেন, সবধরনের সূচক এবং বাজার মূলধন। সেইসঙ্গে বাজারে প্রবেশ করেছে নতুন বিনিয়োগকারী। সিডিবিএল‘র তথ্যানুযায়ী, ৩ আগস্ট বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ২২ লাখ ৯৯ হাজার ১৪০ জন। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে গত ৩০ ডিসেম্বর বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ লাখ ৫০ হাজার ৯৫৯ জন। অর্থাৎ বছরের শেষ পাঁচ মাসে বিনিয়োগকারী বেড়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮১৯ জন।

বাজার মূলধন বেড়েছে ৫৯ হাজার কোটি টাকা

২০২০ সালে লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। করোনার প্রকোপে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ ধস নামলে চলতি বছরের ১৮ মার্চ তা কমে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮২ কোটি টাকায় নেমে আসে। তবে সংকট কাটিয়ে বছরের শেষার্ধে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখীধারায় ফেরায় গত ৩০ শে ডিসেম্বর লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। বছর শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ৫৮ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা।

সূচক গড় লেনদেন বেড়েছে

২০২০ সালের শুরুতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ইনডেক্স ৪ হাজার ৪৫২ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বছরের প্রথম থেকে বড়ধরনের দরপতনের কারণে গত ১৮ মার্চ তা কমে ৩ হাজার ৬০৩ পয়েন্টে নেমে আসে। তবে গত জুন থেকে ধীরে ধীরে পুঁজিবাজার চাঙ্গা হতে শুরু করে। এতে করে গত ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়ে ৫ হাজার ৪০২ পয়েন্টে উন্নীত হয়। ২০২০ সালজুড়ে সূচক বেড়েছে ৯৫০ পয়েন্ট। একই সময়ে বছরের শুরুতে গড় লেনদেন ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে থাকলেও ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকা।

পুঁজিবাজার থেকে হাজার ৭০৯ কোটি টাকা উত্তোলন

বিদায়ী ২০২০ সালে পুঁজিবাজার থেকে আটটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়ে এক হাজার ৭০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। এটি আগের কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে ৫৫২ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ৬০১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০১৭ সালে ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০১৬ সালে ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।

আগস্টে বিশ্বসেরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ২০২০ সালের আগস্টে বিশ্বের মধ্যে সব থেকে ভালো পারফরম্যান্স করে। ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ উত্থান নিয়ে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিশ্বে প্রথম হয়। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে লকডাউনের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি একধরনের চাপে ছিল। করোনায় দেশে আমদানি ও রফতানি কমলেও শক্ত অবস্থানে ছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এছাড়া তৈরি পোশাক খাতে রফতানি আদেশ বাড়ায় এবং রেমিট্যান্সের গতি অব্যাহত থাকায় অর্থনীতিতে স্বাভাবিকতা দেখা যায়।

প্রতিবেদতনে আরও বলা হয়, মে মাসের শেষে পুঁজিবাজারে পুনরায় লেনদেন চালুর পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ২০ শতাংশ বাড়ে। টেলিকম, ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যালস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং প্রকৌশল খাত ভালো অবস্থানে ছিল। আগস্টে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ উত্থান হয়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনাম ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং রোমানিয়ার পুঁজিবাজারে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ উত্থান হয়।

এছাড়া এশিয়ার শেয়ারবাজার উত্থান নিয়ে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ উত্থান হয়েছে। যা বিশ্বের শেয়ারবাজারেও সেরা পার

৩য় প্রান্তিকে পুঁজিবাজারে উত্থান সবচেয়ে বেশি

২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সব মহাদেশের মধ্যে এশিয়ার পুঁজিবাজারগুলো সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করে। আর এককভাবে দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি উত্থান হয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটাল লিমিটেডের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। তৃতীয় প্রান্তিক, তথা জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উত্থান ছিল বিশ্বের সব দেশের চেয়ে বেশি— ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তানের পুঁজিবাজারে উত্থান ছিল ১৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর ১৭ শতাংশ উত্থান নিয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল শ্রীলঙ্কা।

এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এশিয়ার পুঁজিবাজারের মধ্যে বাংলাদেশের এই উত্থানের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আকর্ষণীয় মূল্য, কম সুদহার, করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি সচল হওয়া এবং রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমেই। বিদেশিদের নিট বিক্রির পরিমাণ বেশি থাকলেও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগেই এই উত্থান হয়েছে।

ডিএসই পুঁজিবাজার বিএসইসি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর