দেশপ্রিয়র বাড়ি রক্ষায় আদালতে যাবেন বিশিষ্টজনেরা
৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৬:২৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: শতবর্ষ প্রাচীন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি রক্ষায় মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। আর অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত এই জমি ও ভবন সংরক্ষণের মাধ্যমে সেখানে একটি জাদুঘর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিশিষ্টজন এ অভিমত দিয়েছেন।
লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি সাংবাদিক আলীউর রহমান সরকারের কাছে তিন দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হচ্ছে- যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তর সম্পত্তি নিয়ে যেসব দলিল তৈরি করা হয়েছে সেগুলো দেশের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে বাতিল ঘোষণা করা। চট্টগ্রাম জেলা যুগ্ম জজের প্রথম আদালত থেকে দেওয়া আদেশ এবং উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসকে না জানিয়ে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি দখল করতে পুলিশি তৎপরতার যথাযথ তদন্ত করা, অর্পিত সম্পত্তিটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে ঐতিহাসিক ভবনটি অক্ষত রেখে পেছনে বহুতল ভবন তৈরি করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন স্মৃতি জাদুঘর ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে পরিচালনা করা।
চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জে আঠারো শতকের খ্যাতিমান বাঙালি আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনের গড়ে তোলা বাড়িটির একাংশ সোমবার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় আকস্মিকভাবে নিজেদের মালিক দাবিদার একটি পক্ষ। খবর পেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত স্থানীয়দের নিয়ে ভবনটির সামনে অবস্থান নেন। প্রতিরোধের মুখে তখন ভবন ভাঙা বন্ধ রাখা হয়। প্রায় দুঘণ্টারও বেশি সময় ধরে উত্তেজনা, বাদ-প্রতিবাদের পর জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে বাড়িটি সিলগালা করে দেন।
বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বেদখল হয়ে আছে। এর জমির পরিমাণ ১৯ গণ্ডা এক কড়া। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত বাড়িসহ জমিটি জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি ‘বাংলা কলেজ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সর্বশেষ সেখানে ‘শিশুবাগ’ নামে একটি স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল।
যাত্রা মোহন সেনের সন্তান দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। ১৯১৯ সালের ২ নভেম্বর তিনি কোলকাতায় মারা যান। তার স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাড়িটিতে ছিলেন। সেসময় তিনি ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে চিকিৎসার জন্য সেখানে যান। দেশে ফিরে তিনি দেখেন বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে। এরপর তিনি ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান সরকার সেটিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে।
দখলী পক্ষ ইজারা নিয়ে ১৯৭৫ সালে সেই বাড়িতে ‘শিশুবাগ স্কুল’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। তবে বৃটিশ আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ভবনটি অক্ষত রাখা হয়। ইজারাগ্রহীতা শামসুদ্দিন মো. ইছহাকের সন্তানরা এখন সেটি পরিচালনা করছিলেন। সোমবার পুলিশের উপস্থিতিতে স্কুলের শিক্ষকদের জোরপূর্বক সেখান থেকে বের করে দিয়ে ভবনটির একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় এম ফরিদ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির লোকজন। ভবনসহ জমিটি দখলে আদালতের নির্দেশনা আছে বলে জানান ঘটনাস্থলে থাকা ফরিদের দুই ছেলে। তবে উচ্ছেদ সংক্রান্তে জেলা প্রশাসনকে অন্ধকারে রেখে শুধুমাত্র পুলিশের সহায়তায় ঐতিহ্যবাহী ভবনটির একাংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ভবনটি ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বিশিষ্টজনেরা।
এ প্রেক্ষাপটে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে টেলিফোনে যুক্ত হয়ে ড. অনুপম সেন বলেন, ‘যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তের বাড়িটি দখল করে সেখানে বাংলা কলেজ ও পরবর্তীতে সেখানে শিশুবাগ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা অন্যায় হয়েছে। ঐতিহাসিক সেই ভবনকে সরকার ইজারা দিয়ে অন্যায় করেছে। এরপর এখন আরেকপক্ষ এসে নিজেদের মালিক দাবি করে সেটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে, সেটাও অন্যায়। ভবনটি চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। আমরা চাই না সেটি হারিয়ে যাক। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে ভবনটি সরকার অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার দাবি করছি।’
আবুল মোমেন বলেন, ‘সংবিধানের ২৪ ধারায় ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বিনাশ থেকে রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার কথা বলা আছে। প্রত্নতত্ত্ব আইনেও বিষয়টি বলা আছে। দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি যেহেতু বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু ঐতিহাসিক এই ভবনটি রক্ষায় সরকারের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। অতীতে চট্টগ্রাম আদালত ভবন ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। তখন আমরা প্রত্নতত্ত্ব আইনটিকে সামনে রেখে মামলা করেছিলাম। আইনি লড়াই করে আমরা আদালত ভবন রক্ষা করেছিলাম। যতীন্দ্র মোহন সেনের বাড়ি রক্ষার জন্যও প্রয়োজনে মামলা করা হবে। ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকেরও কর্তব্য। একজন নাগরিক হিসেবে আমরা চাই, ভবনটি রক্ষায় রাষ্ট্র উদ্যোগী হোক।’
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অতীতেও চট্টগ্রাম আদালত ভবন, রেলস্টেশন, সিআরবি নিয়ে আমরা এই পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ সেই ভবনগুলোও ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। আমরা পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম গঠন করে সেদিন এই অপকর্ম রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের প্রতিবাদ যৌক্তিক হওয়ায় সরকার সেই ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। যতীন্দ্র মোহনের বাড়িটি রক্ষার বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, পাবনায় সুচিত্রা সেনের ভিটেমাটি যেভাবে সরকার অধিগ্রহণ করে সেটাকে স্মৃতি সংগ্রহশালা করেছে, একই আদলে এই ভবনটিও রক্ষা করা হোক। অন্যথায় আইনি প্রক্রিয়ায় যেভাবে চট্টগ্রাম আদালত ভবন আমরা রক্ষা করেছি, একই পদক্ষেপ এক্ষেত্রেও গ্রহণে আমরা পিছপা হব না।’
জাল নথি সৃজন করে যতীন্দ্র মোহনের বাড়ি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘বাড়িটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে গণ্য আছে। জেলা প্রশাসক এর কাস্টডিয়ান কিন্তু মালিক নন। দখলদার ফরিদ উদ্দিনের পক্ষে আদালাতের আদেশের যে নথি দেখানো হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে মিলন সেনগুপ্ত বনাম ফরিদ। যে জমির মালিক মিলন সেনগুপ্ত নন, বিক্রির ক্ষেত্রে তিনি কিভাবে পক্ষভুক্ত হন। উনার তো বিক্রির কোনো আইনগত অধিকার নেই। জাল দলিল সৃজন করে আদালতকে বিভ্রান্ত করে তারা একটা আদেশ এনেছেন যেটা অবৈধ।’
আলীউর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দখলদার ফরিদ উদ্দিন একজন ভূমিদস্যু। আমরা জানতে পেরেছি, উনি সারাদিন আদালত ভবনে ঘোরাঘুরি করেন। উনার কাজ হচ্ছে জাল দলিল তৈরি করে সম্পত্তি দখল করা এবং নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা। এই ফরিদ উদ্দিনকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ভবনটি দখল করিয়ে দিতে সহযোগিতা করেছে পুলিশ। আদালতের আদেশ হয়েছে আগেরদিন বিকেল ৪টায়। রাত ৯টায় কোতোয়ালী থানার ওসি আদেশ পেয়েছেন। উনি এই ভবনের ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে নিশ্চয় অবগত। উনি সারাক্ষণ সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, অথচ এই ভবনটি যে ভাঙা হবে সেই বিষয়ে তিনি কাউকে কিছু জানাননি। একইভাবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা এর যথাযথ তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রণজিৎ কুমার দে, সিপিবি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত, আইনজীবী সুভাষ লালা ও চন্দন দাশ, জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, শিল্পী শাহরিয়ার খালেদ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র ইউনিয়নের বিক্ষোভ মিছিল
এদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়ন। মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এ্যানি সেনের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সাংগঠনিক সম্পাদক টিকলু কুমার দে, কোষাধ্যক্ষ রনি কান্তি দেব, পাহাড়তলী থানা সংসদের যুগ্ম আহ্বায়ক নিশান রায়, হালিশহর থানা সংসদের আহ্বায়ক আশিক এলাহী, কোতোয়ালী থানা সংসদের কোষাধ্যক্ষ অয়ন সেনগুপ্ত, সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী শুভ নাথ। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী। চবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি গৌরচাঁদ ঠাকুর অপু এবং চুয়েট সংসদের সদস্য চিরঞ্জিত দাশ প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি জানান।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ‘যে বাড়িটি ভাঙা হয়েছে সেটি শুধু সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি নয়, সেখানে মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ বিভিন্ন শীর্ষ নেতাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাড়িটি ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার। দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। যুবলীগের নামধারী প্রভাবশালী গোষ্ঠী স্কুলের শিক্ষক এবং ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আধঘণ্টার মধ্যেই একটি বুলডোজার এসে ভবনটির সামনের অংশ ভেঙে দেয়। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি ও প্রগতিশীল চেতনার ওপর আঘাত। অতীতেও এই ধরনের মৌলবাদী ও দখলদার শক্তি সরকারি পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির লড়াই সংগ্রামের চেতনাকে মুছে দিতে চেয়েছে।’
অবিলম্বে দখলবাজ দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা।
মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রেসক্লাবে গিয়ে শেষ হয়।