গায়ের রঙের সৌন্দর্য !
১১ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৫:০৬
মাকসুদা আজীজ
টুম্পা আজন্ম শুনেছে এসেছে সে কালো। তার দীঘল চুল, ডাগর চোখ এগুলো নিয়ে সে কোনদিন কিছু শোনেনি। যাও বা শুনেছে তাও শর্ত জুড়ে। যেমন, মেয়েটি কালো হলেও চেহারাটা মিষ্টি অথবা কালো মেয়েদের চুল বরাবরই ভালো হয়। টুম্পার মেধা, যোগ্যতা এগুলো ছাপিয়ে তার গায়ের রঙ সামনে চলে আসে সবসময়। তার মা পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই আফসোস করে বলতেন, ‘আমার কালো মেয়েটাকে কে নেবে?’
বিয়ের দিন সবাই বারবার করে টুম্পাকে বলে দিল, সবার আগে গায়ের রঙটা যেন ঠিক করে নেয় অর্থাৎ মেকআপের সাহায্যে রঙ যেন ফরসা করা হয়। পার্লারে সাজতে গিয়ে টুম্পার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে মেকআপ আর্টিস্টকে বিশেষ করে বলে দিল, গায়ের রঙ যা আছে তাই রেখে যেন স্বাভাবিকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু সেই স্বাভাবিক সাজ দেখে সকলের সে কি মন খারাপ! শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কীয় এক আত্মীয় তো বলেই বসলেন, ‘টুম্পার চেয়ে তার বড় জাকে বেশি বৌ বৌ দেখাচ্ছে।’ আরেকজন নির্মমভাবে আক্রমণ করে বললেন, ‘বড় বৌটা সুন্দর, এইটা বিশ্রি!’
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখের যত প্রশংসাই গল্প কবিতা বা গানে উঠে আসুক না কেন, গায়ের রঙ কালো, বাদামী এমনকি সামান্যতম গাঢ় হওয়াটাও একজন মানুষের জীবনে অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো এই গায়ের রঙ হয়ে ওঠে তার জীবন এবং অস্তিত্বের চেয়েও বড় । একজন মানুষ বিশেষ করে সে যদি নারী হয় তবে তো পুরো সত্ত্বা ছাপিয়ে এই একটা বৈশিষ্ট্যই তার একমাত্র পরিচয় হয়ে যায়।
গাঢ় গায়ের রঙ যেটাকে প্রচলিত ভাষায় মানুষ কালো, ময়লা, শ্যামা ইত্যাদি দিয়ে অভিহিত করে সেটা আসলে আসে একটা শক্তির খেলা থেকে। এই খেলায় প্রচলিত নিয়মে কালোরা হেরে গিয়েছে। তবে তুলনা করলে দেখা যায়, সাদারাও সেখানে জিতে বসে নেই। ধরা যাক, একজন ফর্সা ব্যক্তি, প্রচলিত নিয়ম মেনে যে আসলে সুশ্রী। কিন্তু সমাজ চাচ্ছে না তার মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস থাকুক এবং সে দৃপ্ত পদক্ষেপে জীবন চালিয়ে যাক। তখন তার সৌন্দর্য, ফর্সা রঙ তাকে রক্ষা করতে পারে না। ফলে, কালো, ময়লা, শ্যামা ইত্যাদির মতো ফর্সাদেরও হেয় করার মতো শব্দমালা প্রয়োগ করা হয় যেমন, ধলা কদু, ভ্যাটকা ফর্সা ইত্যাদি।
আমাদের সমাজে নারীর পাশাপাশি পুরুষরাও গায়ের রঙ নিয়ে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয় প্রতিনিয়ত। যোগ্যতা থাকা সত্বেও শুধুমাত্র কালো হওয়ার কারণে চাকরি না পাওয়া ব্যক্তির বন্ধুদের দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ঘটনাও খুব বিরল নয়।
গায়ের রঙের কারণে হেরে যাওয়ার পরিস্থিতিকে পুঁজি করে আবার রঙ ফর্সাকারী পণ্যগুলো জিতে যাওয়ার নানান তরিকার সন্ধান দিচ্ছে। ফলে আমাদের সমাজে এখন এটা স্বীকৃত সত্য যে, গায়ের রঙ অন্যের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী না হলে, সে জীবনে কিছু করতে পারবে না, এগোতে পারবে না এমনকি সে কারো ভালোবাসাও পাবেনা। এটি এমন একটি জীবনের দিকে ঠেলে দেয় যেটা আসলে কেউই যাপন করতে চায় না।
রূপের ঝলকানি যখন শুধুই গায়ের রঙে এসে ঠেকে তখন, সুপার মডেল অ্যালেক অয়েক হতে পারেন সবার জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি মনে করেন, ‘যখন ভেতর থেকে সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়, তখন সেটা অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে যায়।’
গুগলে Alek Wek লিখে সার্চ দিলেই বোঝা যাবে এই ছোট্ট নামটির শক্তি কতটা প্রবল, কেননা অ্যালেক কোনো প্রচলিত অর্থে রূপসী নন। অ্যালেকের বাড়ি সাউথ সুদান। সে দেশের মানুষদের মতোই অ্যালেক ঘন কৃষ্ণবর্ণের, তার মাথায় তারের মতো প্যাঁচানো খুলি আঁকড়ানো চুল। শুধু তাই নয়, সুপার মডেল হওয়ার পথে কোনোধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষনের পথ পাড়ি দেননি তিনি। পরিবার পরিজনদের নিয়ে তার যুদ্ধপ্রবণ মাতৃভূমি থেকে শরনার্থী হয়ে যুক্তরাজ্য পাড়ি দিয়েছিলেন অ্যালেক। সেখানকার একটি মডেল এজেন্সিই তাকে খুঁজে নেয়। হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ ককেশীয় নারীর মধ্য থেকে এই মেয়েটি কীভাবে এজেন্সির লোকদের চোখে পড়লো, যদি না তার ভেতর থেকে কোন সৌন্দর্য্য উদ্ভাসিত হয়ে থাকে?
ফ্যাশন হাউজ বিবিয়ানার কর্ণধার ও ডিজাইনার লিপি খন্দকার মনে করেন, রূপের এই উদ্ভাস মূলত আসে কেউ নিজেকে কতটা সঙ্গতভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তার উপর। এতে গায়ের রঙের প্রভাব খুবই গৌণ। পোশাকের রঙে, সাজের আনুষঙ্গিকতায় সৌন্দর্য সম্পূর্ণভাবে উঠে আসছে কি না সেটাই গুরুত্বপূর্ন। তিনি মনে করেন অনুষ্ঠান অনুযায়ী বা ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে পোশাকের রঙ মানানসই কিনা অথবা সেটা চোখে আরাম দিচ্ছে কিনা এসব ভারসাম্য রক্ষার মধ্যদিয়েই সৌন্দর্য প্রকাশ করা যায় নান্দনিক রূপে।
গায়ের রঙ অনুযায়ী সাজগোজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হালকা গায়ের রঙে যেমন প্রায় সব রঙ মানিয়ে যায় তেমনি গাঢ় রঙেও সব রঙ ফুটে উঠে। এটা কোনো অংশেই কম সুন্দর নয়। কারও গায়ের রঙ যদি গাঢ় হয়, খুব হালকা হয়, ফ্যাকাসে হয় বা লালচেও হয় এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই বরং মানানসই সাজ পোশাক আর স্বাস্থ্যজ্জ্বল ত্বকের সাথে চমৎকার ব্যক্তিত্বের মিশেলই পারে একজন ব্যক্তির ভেতরের সৌন্দর্যকে উদ্ভাসিত করতে।
তাই গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতা কিংবা আলোচনা সমালোচনার কোন সুযোগ আর এই একবিংশ শতাব্দিতে নেই। যারা এখনো এই অভ্যাসটি জিইয়ে রেখেছেন, বরং তাদেরকেই কোনঠাসা হতে হবে ক্রমে। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে, যাবে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সৌন্দর্যকে কেউ নিজস্ব রুচি, প্রাচীন ধ্যানধারণা আর আধিপত্যবাদে আটকে রেখে সংজ্ঞায়িত করার রাজনীতি আর বেশিদিন টেনে নিয়ে যেতে পারবে না।
অলংকরণ- আবু হাসান
সারাবাংলা/ এমএ/ এসএস