কর্মসূচি-আদর্শ নিয়ে মতপার্থক্যে ভাঙনের মুখে বাম গণতান্ত্রিক জোট
১৫ জানুয়ারি ২০২১ ১০:১১
ঢাকা: আন্দোলন-কর্মসূচি, আদর্শ-উদ্দেশ্য নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোটে। এতে করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিয়েছে এই জোটে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ‘দুই দলীয় বৃত্তে’র বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ার কর্মসূচি নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। ফলে রাজনৈতিক জোট হলেও রাজনৈতিক কার্যক্রমের দিক থেকে গতি হারিয়েছে দেশের বাম রাজনীতির শীর্ষ এই জোট।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জোটটি যে আদর্শ-উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল, জোট নেতাদের নানা কর্মকাণ্ডে সেই আদর্শ-উদ্দেশ্য-লক্ষ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। জোট নেতাদের কেউ কেউ বিএনপি ও বিএনপির মিত্রদের সঙ্গে একই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন। কেউ আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। ফলে আদর্শ-উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থান তাদের। শরিক দলের কেউ কেউ আবার নিষ্ক্রিয়।
জোটের নেতাকর্মীরা বলছেন, জোটের কোনো কোনো নেতার সঙ্গে বাকি অনেকের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য প্রকট হয়ে উঠছে। এরকম চলতে থাকলে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা জোটের নেতাকর্মীদের।
২০১৮ সালে ১৮ জুলাই রাজধানীর পল্টনে মুক্তি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে এই বাম গণতান্ত্রিক জোট। যে আটটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল নিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা হয়, সেগুলো হলো— বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লিগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে কেবল কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন রয়েছে। বাকি পাঁচটি দলের নিবন্ধন নেই নির্বাচন কমিশনে।
মুক্তি ভবনকেই জোটের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জোটের আত্মপ্রকাশের ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়— দুঃশাসন, জুলুম ও লুটপাটতন্ত্র প্রতিহত করা এবং গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রম জোরদার করার উদ্দেশ্যেই এই জোট গঠন করা হয়েছে।
তবে যাত্রা শুরুর পর থেকে বাম গণতান্ত্রিক এই জোটের খুব বেশি কর্মসূচি দৃশ্যমান হয়নি। সবশেষ এই জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে যাত্রার কর্মসূচি থাকলেও পল্টন থেকে সেই পদযাত্রা শাহবাগ অতিক্রম করতে পারেনি। পুলিশি বাধার মুখে শাহবাগেই থামতে হয় তাদের।
এছাড়া জোটের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে সরকারবিরোধী যে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া প্রয়োজন, তার অনুপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে নেতাকর্মীদের মনে। তারা বলছেন, জনসম্পৃক্ত অনেক ইস্যুতেই জোট কোনো কর্মসূচি নিতে পারছে না। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে এক ধরনের হতাশাও কাজ করছে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণতান্ত্রিক বাম জোটের প্রভাবশালী একজন নেতা সারাবাংলাকে বলেন, পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া দেশ ও জনগণের মুক্তি নেই। সে কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের এটিই মূল অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হলে কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। এজন্য কর্মসূচি রয়েছেও। কিন্তু কর্মসূচির কার্যকারিতা নেই। এ থেকে জোটের দুয়েকটি শরিক দল হঠাৎ করে দূরে সরে গেছে।
নাম উল্লেখ না করে দুইটি দলের কথা জানান জোটের এই নেতা। তিনি বলেন, দুইটি দলের নেতারা অন্য দলের কর্মসূচিতে গিয়ে যোগ দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্য অনেক সময়ই দেখা যাচ্ছে বাম জোটের আদর্শ-উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ছে। এছাড়াও ছোট-খাটো আরও বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আভ্যন্তরীণ ঝামেলাও চলছে। ঝামেলা মিটে না গেলে হয়তো বাম গণতান্ত্রিক জোট ভেঙে যেতে পারে।
বর্তমানে কী অবস্থা এই জোটের— জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাম জোট থেকে সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দলগুলোকে বর্তমান দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানানো হয়ে আসছে আগে থেকেই। সে অনুযায়ী কমসূচিও আমরা পালন করে থাকি। বাম জোটের আনুষ্ঠানিক অবস্থান এটিই। সে অনুযায়ী কর্মসূচিও পালন করা হয়। ফলে আমাদের আদর্শিক অবস্থান বা কর্মসূচি নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বরং আমাদের কারও কারও মধ্যে বিভ্রন্তি আছে যে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণজাগরণ তৈরি করা হলে এর পরিণতি কী হবে, সেটি নিয়ে। এটি নিয়ে তাদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ-আতঙ্ক রয়েছে।
প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতির বিপক্ষে আদর্শিক অবস্থান থাকলেও বিএনপি বা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে জোটের কোনো কোনো শরিক দলের কর্মসূচি নিয়ে জানতে চাইলে সাইফুল হক বলেন, এই মুহূর্তে আমরা বিএনপি বা তাদের মিত্রদের সঙ্গে একসঙ্গে আন্দোলন কিংবা জোট বা মোর্চা গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করছি না। তবে কয়েক বছর ধরে আমরা অন্য ব্যানারে বিএনপির মিত্রদের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। তারাও আমাদের অনুষ্ঠানে আসছেন। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান ফ্যসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোনের ঐক্য গড়ে তোলা। সে কারণে কেউ যদি নিজ দল ও জোটের অবস্থানকে অটুট রেখে জনগণের ভোটাধিকার আদায় ও গণতন্ত্র রক্ষা এবং সরকারকে পদত্যাগে করিয়ে নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে সুষ্ঠু-অবাধ নির্বাচন আয়োজনের কোনো প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। এ নিয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে কোনো মতপার্থক্যও নেই। এই ইস্যুতে রাজপথে সমন্বিত একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ার জন্য বাম জোটের আহ্বান আনুষ্ঠানিকভাবেই আছে।
জোটের ভাঙনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে বাম জোটে ভাঙনের কোনো আশঙ্কা নেই। এটি আমার ওপর নির্ভরও করছে না। তবে বাম জোটের কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর