অবহেলায় শিশুমৃত্যুর অভিযোগ, সিকদার নার্সিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা
২০ জানুয়ারি ২০২১ ১৭:৫৮
ঢাকা: সন্তানসম্ভবা ছিলেন রুনা। স্বামী আব্দুল বাতেন শুরু থেকেই তিন সন্তানের এই জননীর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে আসছেন রাজধানীর পোস্তগোলা ব্রিজ সংলগ্ন সিকদার নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানকার গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. সানজিদা হক পিংকির অধীনে ছিলেন রুনা। বিভিন্ন সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রুনার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক জানালেও গত ডিসেম্বরে এসে চিকিৎসক জানান, জরুরিভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করতে হবে রুনার। সে অনুযায়ী সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন রুনা। শিশুটির জন্মের পরই চিকিৎসক জানান, শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন। পরে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হলে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
আব্দুল বাতেনের অভিযোগ, সিকদার নার্সিংয়ের চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণেই তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। এ অভিযোগে তিনি প্রথমে শ্যামপুর থানায় অভিযোগ করেন। থানা অভিযোগ না নিলে হাসপাতালের পাঁচ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন শিশুটির বাবা। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
ঘটনার বিষয়ে শিশুটির বাবা আব্দুল বাতেন সারাবাংলাকে বলেন, ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানজিদা হক পিংকির কাছে আমার স্ত্রীকে দেখাচ্ছিলাম। নভেম্বরের শুরুতে তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। ওই হাসপাতালেই পরীক্ষাগুলো করানো হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট আসে, গর্ভে থাকা শিশুর বয়স ৩১ সপ্তাহ ৪ দিন, ওজন প্রায় এক হাজার ৮১৫ গ্রাম। ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি। রিপোর্ট ডাক্তারকে দেখালে তিনি বলেন, আর অন্য কোনো সমস্যা নেই। তিনি কিছু ওষুধ লিখে দেন।
বাতেন মিয়া বলেন, এরপর ২৩ ও ২৯ নভেম্বর ডা. সানজিদাকে আবার দেখানো হয়। তখন তিনি কিছু ওষুধ লিখে দেন। এরপর ১ ডিসেম্বর ডা. সানজিদার পরামর্শে ওই হাসপাতালেই আলট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। রিপোর্টে বেবির ওজন দেখানো হয় দুই হাজার ৮১২ গ্রাম, বয়স ৩৫ সপ্তাহ ৫ দিন, শিশুর দৈর্ঘ্য ৮ সেন্টিমিটার দেখানো হয়। তবে শিশুর ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ দেখানো হয় ৩১ ডিসেম্বর।
একই হাসপাতালে ৪ ডিসেম্বর ডা. সানজিদার পরামর্শে আরও কিছু পরীক্ষা করানো হয় রুনার। তার পরামর্শেই ৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় রুনাকে। ১২ ঘণ্টা পর পর তাকে তিনটি ইনজেকশন দেওয়া হয়। ৫ ডিসেম্বর আবারও নতুন করে পরীক্ষা করান ডা. সানজিদা। এদিন শিশুর ওজন আসে দুই হাজার ৬১৬ গ্রাম। ডেলিভারির তারিখ দেখানো হয় ৭ জানুয়ারি।
আব্দুল বাতেনের অভিযোগ, এদিন ডা. সানজিদা তাকে ডেকে বলেন, ‘পানি ভেঙে যাওয়ার কারণে রুনার সিজার করাতে হবে। সিজার না করালে পরে বাচ্চার কোনো ক্ষতি হলে আমাদের দোষ দিতে পারবেন না।’ পরে ৫ ডিসেম্বর রাতেই ২০ হাজার টাকার চুক্তিতে রুনার সিজার করানো হয়।
আব্দুল বাতেন বলেন, সিজারের আগে কিছুই বললেন না, অথচ সিজারের কিছুক্ষণ পর ডা. সানজিদা বলেন, বাচ্চাকে জরুরিভাবে আইসিইউতে নিতে হবে। আমাদের এখানে আইসিইউ নেই। এজন্য অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো— সিজারের পর আমার স্ত্রী বাচ্চাকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে দেখতে দেয়নি। আইসিইউ না থাকার কথাও আগে বলেননি। অনেকক্ষণ পর তারা আমাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। আবার সিজারের পর বাচ্চার ওজন দেখাচ্ছে তারা এক কেজি ৯০০ গ্রাম, কিছুক্ষণ পর জুরাইন আদ-দ্বীন হাসপাতালে শিশুকে নিয়ে গেলে সেখানে শিশুর ওজন পাওয়া যায় এক কেজি ৫০০ গ্রাম। সেখানে আবার এনআইসিইউ না থাকায় পরে ছেলেকে নিয়ে যাই যাত্রাবাড়ী ডেলটা হেলথ কেয়ারে ভর্তি করানো হয়। সেখানে বাচ্চাকে জরুরিভাবে এনআইসিইউতে ভর্তি করা হলেও ৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায় তার মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, সিকদার নার্সিং হোমের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ছিল কারসাজি। ডা. সানজিদা তড়িঘড়ি করে সিজার করান। বেবির ওজন একেক রিপোর্টে একেক রকমের আসে। আবার সিজারের পর অন্যরকম হয় ওজন। বাচ্চার পিঠ-বুক, হাত-মুখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে কালো কালো দাগ হয়েছে। জানি না ওরা কী করেছে। ডেলটা হাসপাতালের চিকিৎসকরা বারবারই বলেছেন, সিজারের সময় বাচ্চা বেশ কয়েকটি স্থানে আঘাত পেয়েছে। যেখানে সিজার হয়েছে, সেখানেই হয়তো কোনো ধরনের জটিলতা হয়েছিল।
সন্তান হারানো পিতা আব্দুল বাতেন আরও বলেন, ‘আমার তিন কন্যা সন্তান আছে। একমাত্র ছেলে দিয়েছিল আল্লাহ। কিন্তু ওই কসাই ডাক্তাদের অবহেলায় আমার ছেলে মারা গেছে। আমার স্ত্রী-সন্তানদের অবস্থা পাগলপ্রায়। এ নিয়ে আমি থানায় অভিযোগ করতে গেলেও পুলিশ কিছুই করতে পারবে না বলে জানায়। পরে ১৪ ডিসেম্বর আমি আদালতে মামলা করেছি।’ সিকদার নার্সিং হোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ নান্নু মিয়া, চিকিৎসক ডা. সানজিদা পিংকি, ডা. এলিজা আক্তার, ডা. এস এম শফি উল্লাহ ও ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আখি আক্তারকে মামলার আসামি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মামলার আইনজীবী আক্তার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আদালত মামলা আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। প্রতিবেদন পেলে আদালত ব্যবস্থা নেবে।
জানা গেছে, এরই মধ্যে তিন দফায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হয়ে তথ্য ও কাগজপত্র দিয়ে এসেছেন আব্দুল বাতেন। অন্যদিকে তদন্ত কমিটির ডাক পাওয়ার পর সিকদার নার্সিং হোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরই মধ্যে লোকজন নিয়ে বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভুল যা হওয়ার হয়েছে, টাকা নিয়ে মীমাংসা করেন।
সন্তান হারানোর বিচার চেয়ে মামলার বাদী শিশুটির বাবা আব্দুল বাতেন বলেন, আমার বাচ্চাকে তারা মেরে ফেলেছে। এর আগেও তারা অনেক শিশুকে এরকম অবহেলায় মেরেছে বলে খবর পেয়েছি। তারা এসেছিল মীমাংসা করতে। আমি মীমাংসা করিনি। আমার মৃত বাচ্চাকে নিয়ে আমি ব্যবসা করতে চাই না। আমি সন্তানকে মেরে ফেলার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি চাই।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিকদার নার্সিং হোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ নান্নু মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ঘটনাটি নিয়ে মামলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরও তদন্ত করছে বিষয়টি নিয়ে। তাই এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর
অবহেলায় শিশু মৃত্যু চিকিৎসকের অবহেলা ডায়াগনস্টিক সেন্টার মামলা সিকদার নার্সিং সিকদার নার্সিং হোম