Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফোর-জি নিয়ে বাড়তি আগ্রহ নেই ফোন ক্রেতাদের


১৯ মার্চ ২০১৮ ০৮:৫১

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

ঢাকা: চতুর্থ প্রজন্মের (ফোর-জি) ইন্টারনেট সেবা চালু হওয়ার পর মোবাইল ফোন সেট বিক্রির বাজারে বড় ধরনের প্রভাবের প্রত্যাশা ও শঙ্কা দুই-ই ছিল সংশ্লিষ্টদের। ধারণা করা হয়েছিল, ফোর-জি এলেই এর ব্যবহার উপযোগী স্মার্টফোনের বিক্রি বাড়বে কয়েকগুণ। আর শঙ্কা ছিল- ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে বাটনযুক্ত ফোনগুলো (বারফোন)। তবে একাধিক মোবাইল ফোন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে এখনও ফোর-জি’র কোনো প্রভাব পড়েনি। এ নিয়ে বাড়তি আগ্রহও নেই ক্রেতাদের।

বিজ্ঞাপন

আমদানিকারক ও বিক্রেতারা বলছেন, নিম্ন আয়ের ক্রেতাসহ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশও বারফোন (বাটনফোন)ব্যবহার করছে। এছাড়া মার্কেটে থাকা বাটনযুক্ত ফোনগুলোও বিক্রি হচ্ছে হরদম। ফলে এসব ফোন খুব সহসাই ‘ইলেক্ট্রনিক্স গার্বেজে’ পরিণত হচ্ছে না।

তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দীর্ঘমেয়াদে বারফোনগুলো অকেজো হয়ে পড়বে। এতে ভবিষ্যতে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতি (বিএমপিআইএ)-এর তথ্যমতে, গত কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর দেশে বৈধ পথে কমবেশি ৩ কোটি করে মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট আমদানি হচ্ছে। যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হ্যান্ডসেট আমদানি হলেও ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৫০ লাখে। আর দেশে মোট মোবাইল ফোন সিম ব্যবহারের সংখ্যা ১৪ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

বিএমপিআইএ’র তথ্যমতে, বর্তমানে মোট মোবাইল ফোন গ্রাহকের মধ্যে ২৫ থেকে ২৬ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। সংগঠনটির মতে, ফোর-জি চালু হলেও হ্যান্ডসেট আমদানিতে এখন পর্যন্ত তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সম্প্রতি আনা অধিকাংশ কোম্পানির হ্যান্ডসেটই ফোর-জি ব্যবহার উপযোগী। এছাড়া আগে থেকেই বাজারে পর্যাপ্ত স্মার্টফোন রয়েছে। আবার ২-৩ বছরের পুরোনো হ্যান্ডসেটেও ফোর-জি সাপোর্ট করছে। এসব কারণে সব মিলিয়ে বাজার এখনও স্থিতিশীল।

বিজ্ঞাপন

মোবাইল ফোন বিক্রি হয় এমন কয়েকটি বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, চতুর্থ প্রজন্মের সেবা আসার পরও মোবাইল ফোন বিক্রি বা আমদানিতে কোন প্রভাব পড়েনি। ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের রাজ ইলেক্ট্রনিক্স’র কর্মচারী কামরুল বলেন, বাজারে এখনও দুই ধরনের ফোনই বিক্রি হচ্ছে। ফোর-জি চালুর পর বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। ১০ শতাংশ ক্রেতাও ফোর-জি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছুই জানে না। এছাড়া নেটওয়ার্ক সমস্যা তো আছেই। তিনি জানান, বেচাকেনা রয়েছে আগের মতোই।

ইস্টার্ন প্লাজার ইয়েন টেলিকমে কথা হয় বিক্রয়কর্মী বাধনের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, সব ধরনের ফোনই বিক্রি হচ্ছে। তবে স্মার্ট ফোনের বিক্রিই বেশি। কিন্তু বার ফোন এখনও চলছে।

একই মাকের্টের ফায়েস টেলিকমের আবু বকর বলেন, ফোর-জি আসার পরেও বাজারে নতুন করে স্মার্টফোনের বিক্রি বাড়েনি। থ্রি-জি’র ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, এবার তা ঘটেনি।

অমাদানি করা মোবাইল ফোন বিক্রি হয় এমন বড় মার্কেটের একটি মোতালেব প্লাজা। কয়েকবছর ধরেই সেখানের ঢাকা মোবাইলের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন রাকিব। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, বারফোন এখনও চলছে। কারণ যাদের হাতে স্মার্টফোন রয়েছে তাদের অনেকের হাতে একটি বারফোনও আছে। আবার সব ভোক্তাই এক শ্রেণির নয়। নিম্ম আয়ের মানুষ যেমন একজন রিকশাওয়ালা তিনি কিন্তু ৩ হাজার টাকা দিয়ে ফোন কিনতে আসবে না। কোনোরকম কথা বলা যায় এমন ফোন দিয়েই তিনি কথা চালিয়ে নেন। তাই বাজারে থাকা বার ফোনগুলো ব্যবহার অনুপযোগী নয়। তাই আপাতত আমাদের কোন ক্ষতির শঙ্কা নেই।

পাশেই মোতালেব টাওয়ারে রয়েছে মোবাইল আমদানিকারকদের অফিস। বারফোন আমদানি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা এখনও বারফোন অমদানি করছি। পাইকারি ক্রেতাদের সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারছি না। তাহলে ক্ষতি হবে কীভাবে!

বসুন্ধরা শপিং মলের একাধিক শো-রুমে কথা বলে জানা গেছে, তাদের হাতে থাকা সব ফোনই এখন ফোর-জি সাপোর্টেট। তবে গ্রাহকরা আলাদা করে ফোর-জি সাপোর্টেট ফোন খুঁজতে আসে না। তবে কয়েকজন বিক্রয়কর্মী জানান, দু’একজন গ্রাহক প্রশ্ন করেন, ফোনটি ফোর-জি ব্যবহার উপযোগী কি-না!

এদিকে আমদানিকারক ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে টু-জি বা থ্রি-জি সাপোর্টেড ফোনকেও ফোর-জি বলে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনরে সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, কয়েকটি মার্কেটে এখন টু-জি ব্যবহার উপযোগী হ্যান্ডসেটেও ফোর-জি’র স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ইর্স্টান প্লাজা, মোতালেব প্লাজা ও সুন্দরবন মার্কেটে এই কাজগুলো চলছে। এসব মার্কেটে আরও বেশি তদারকি দরকার।

মুঠোফোন কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণির ক্রেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তবে বড় একটি অংশের ঝোঁক এখন স্মার্টফোনের দিকে। আবার কেউ কেউ বারফোনের কথাও বলছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী ধানমন্ডির বাসিন্দা জহির বলেন, এখন যদি ফোন কিনতে চাই তবে তা হবে অবশ্যই আরও দামি। হতে হবে সর্বশেষ প্রযুক্তি ও ভার্সনের। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মুজাহিদ। তিনিও চান লেটেস্ট ভার্সনের কোন নামিদামি ব্রান্ডের স্মার্টফোন। গেল কয়েকদিন আগেই ফোন চুরি গেছে মুদি দোকানদার ফরিদের। মহাখালীর এই দোকানি বলেন, কোনো রকম একটা ফোন থাকলেই চলত!

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতি (বিএমপিআইএ) সূত্র জানায়, বর্তমানে ফোর-জি ফোনের আমদানি বেড়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অগ্রগতি প্রতীয়মান হয়নি। যদিও এ অল্প সময়ে ফোর-জি ফোনের প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনা করা দুরূহ।

সংগঠনটির এক নেতা বলেন, দেশের সব এলাকা ফোর-জি নেটওয়ার্কের আওতায় আসতে সময় লাগবে। তাছাড়া ব্যয়ের কথা মাথায় রেখে সব ভোক্তা ফোর-জি ব্যবহারে ইচ্ছুক হবে না। ফলে ফোর-জি এলেও আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি নয়।

তবে ফোর-জি সেবাকে তৃণমূলে নিয়ে যেত সংগঠনটির পক্ষে কয়েকটি দাবি রয়েছে। এগুলো হল, ফোর-জি ফোনের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশীয় উৎপাদনে প্রণোদনা। সিম পরিবর্তনে শুল্ক ও মূসক অব্যাহতি। ফোর-জি ফোন কেনায় ভোক্তা পর্যায়ে ঋণ সহায়তা ও বিভিন্ন জনগণকে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ফোর-জি ডাটা চার্জ সাশ্রয়ী করা যেতে পারে বলে সংগঠনটি মনে করে।

মুঠোফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবির সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের বাজারে এখন ৪ শতাংশ স্মার্টফোন ফোর-জি ব্যবহার উপযোগী, যা অপর্যাপ্ত। ৩০ শতাংশ স্মার্টফোন থাকলেও এর সবগুলোতই ফোর-জি ব্যবহারের উপযোগী নয়। তাই ফোর-জি ব্যবহার উপযোগী স্মার্টফোনের সংখ্যা আমরা যদি ৭০ শতাংশে নিতে না পারি, তবে তৃণমূলে ফোর-জি সেবা পৌঁছাবে না। তৃণমূলের সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার জন্যে সরকারীভাবে প্রণোদনা ও সহায়তা প্রয়োজন।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ফোর-জি ব্যবহার উপযোগী হ্যান্ডসেট তৈরিতে আমরা আঞ্চলিকভাবে জোর দিচ্ছি। দেশেই যাতে ৩-৪ মাসের মধ্যে এমন হ্যান্ডসেট তৈরি করা যায় সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তবে বাড়তি কোন সহায়তা নিয়ে ভাবছি না।

এ প্রসঙ্গে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, আমরা মুঠোফোনের আমদানি বন্ধ করতে চাই। ১৪ কোটি মানুষের ব্যবহার উপযোগ হ্যান্ডসেট যাতে দেশেই উৎপাদন করা যায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। দেশেই এরইমধ্যে কয়েকটি কোম্পানির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। টু-জি, থ্রি-জি ও ফোর-জি ব্যবহার উপযোগী, অর্থাৎ সব ধরনের হ্যান্ডসেটই আমরা দেশে বানাব। দেশীয় উৎপাদনকে বাড়াতে প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক বাড়ানো হবে। বাজারে মোবাইল পাওয়ার ব্যবস্থা করলে, আর-তো অন্য কোনো সহায়তার প্রয়োজন নেই।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক প্রযুক্তির জায়গায় আরেক প্রযুক্তি আসবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তাই কোনো এক সময় বাটনফোন বিলুপ্তি  ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

সারাবাংলা/এএইচটিি/এসআই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর