Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দখলদারদের সরিয়ে দেশপ্রিয়র বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিল জেলা প্রশাসন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৩ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:১৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেই বাড়ির সামনে টানানো হয়েছে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখা সাইনবোর্ড। একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি আবুল মোমেন ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তের ডাকে আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় সরকারের পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকেলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি) বদিউল আলমের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি দল নগরীর রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে যায়।

এর আগেই আবুল মোমেন ও রানা দাশগুপ্তের আহ্বানে সেখানে অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করছিলেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা। জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি এবং পুলিশ-আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তাদের করতালি দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এসময় স্লোগান দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়।

জেলা প্রশাসনের টিম মূল গেটে লাগানো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানে অবৈধভাবে অবস্থান করা কয়েকজন নারী-পুরুষকে তারা বের করে দেন। বাড়ির গেট ও দেওয়ালে লাগানো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সব সাইনবোর্ড ও ব্যানার খুলে ফেলে দেওয়া হয়। গেটে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণে সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা সম্বলিত একটি এবং এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনার একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভেতরে লাগানো হয় জাদুঘর সংক্রান্ত জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ড।

এছাড়া আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বাড়ির সীমানা দেওয়ালে ‘বিপ্লবী জাদুঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত স্থান’ লেখা একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। জেলা প্রশাসনের টিমে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (মেট্রো) সুমনী আক্তার, বাকলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তৌহিদুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি) বদিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা। যাত্রামোহন সেনের এই বাড়ির সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ইতিহাসও জড়িত। কতিপয় দৃষ্কৃতকারী অবৈধ অনুপ্রবেশ করে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙচুর করে। পরে হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি রিট হয় এবং তার ফলে হাইকোর্ট রুল জারি করে। সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ এবং হাইকোর্টের রুলের প্রেক্ষিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে জেলা প্রশাসন এই ঐতিহাসিক স্থাপনার রক্ষার জন্য এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ঐতিহাসিক বাড়িটিতে সার্বক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন থাকবে বলে জানান বদিউল আলম। এছাড়া এই বাড়িতে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় ঐতিহাসিক বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্প্রতিকালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠিও এসেছে এই স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। সেজন্য অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে এখানে একটি জাদুঘর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’

এর আগে, বিকেল ৩টা থেকে বাড়িটির সামনে শুরু হওয়া অবস্থান কর্মসূচিতে একে একে বিশিষ্ট নাগরিকরা যোগ দেন। উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি শহীদজায়া বেগম মুশতারি শফী, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, নারীনেত্রী নুরজাহান খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রনজিৎ চৌধুরী ও জীনবোধি ভিক্ষু, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন, গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সমন্বয়ক শরীফ চৌহান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদ হাসান, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের সভাপতি আলীউর রহমান, জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা তাপস হোড় ও শ্যামল কুমার পালিত, আওয়ামী লীগ নেতা নঈমউদ্দিন আহমেদ, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অ্যানি সেন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম মহানগর যুব ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রুবেল পাল।

বেগম মুশতারি শফী বলেন, ‘আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এই বাড়িটি সরকার দখলে নিয়ে জাদুঘর করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই বাড়িটি রক্ষার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে। উদীচীসহ চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে, রাজপথে আন্দোলন করেছে। এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক এই বাড়িটি রক্ষা পেয়েছে। আমি আন্দোলনকারী সকলকেও ধন্যবাদ জানাই।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘ঐতিহাসিক ভবনটি দখলদারদের হাত থেকে রক্ষায় আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এসেছিলেন। তিনি ভবনটি রক্ষার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি নওফেলকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি তার কথা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ উনার দৃষ্টি ছিল বলেই কেন্দ্রীয় নেতারা এখানে এসেছিলেন। জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই তারা বাড়িটি রক্ষার পদক্ষেপ নিয়েছে।’

নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি কারও জমি বাড়ি দখলের জন্য নয়। এটা আমরা হতে দেব না। রানা দাশগুপ্ত আমাদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। সেই স্মৃতি রক্ষায় জাদুঘর করতে হবে। নেত্রীর ওপর আমরা ভরসা করতে পারি।’

শরীফ চৌহান বলেন, ‘জনতার সংগ্রাম বিফল হয় না তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই বাড়িটি দখলদারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। কিন্তু খুশি হয়ে ঘরে ফিরে গেলে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর যতদিন হবে না ততদিন রাজপথে থাকতে হবে। শুধু এই বাড়ি নয়, আহ্বান জানাই সব বিপ্লবীদের স্মৃতি ও বধ্যভূমি রক্ষার, আশা করি আন্দোলনে সবাইকে সঙ্গে পাব।’

উল্লেখ্য, নগরীর রহমতগঞ্জে ঐতিহাসিক বাড়িটি আঠারো শতকের খ্যাতিমান বাঙালি আইনজীবী যাত্রামোহন সেনগুপ্তের। তার ছেলে দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালে কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান। তার স্ত্রী কংগ্রেসনেত্রী নেলী সেনগুপ্ত ১৯৭০ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে চিকিৎসার জন্য দিল্লী যান। দেশে ফিরে তিনি দেখেন, তার বাড়িটি দখল হয়ে গেছে। পরে ভারতে চলে যান তিনি। ১৯৭৩ সালে নেলী সেনগুপ্ত মারা যান। তাদের বাড়িসহ সব সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।

সেই বাড়ি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেন শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি। সেখানে প্রথমে বাংলা কলেজ এবং ১৯৭৫ সালের পর শিশুবাগ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। শামসুদ্দিনের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা স্কুলটি পরিচালনা করছিলেন। তবে সেখানে যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি তারা অক্ষত রেখেছিলেন।

গত ৪ জানুয়ারি এম ফরিদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি বাড়িটি কিনেছেন দাবি করে কিছু লোকজন সেটি দখল করতে যান। সন্ত্রাসী কায়দায় প্রথমে শিশুবাগ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হয়। এরপর বুলডোজার দিয়ে ঐতিহাসিক বাড়িটির সামনের অংশ ভাঙা শুরু করে। খবর পেয়ে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত স্থানীয়দের নিয়ে বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেন। পরে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে যান। তিনি নথিপত্র পর্যালোচনা করে ভবনটি না ভাঙার নির্দেশ দেন।

৬ জানুয়ারি একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বাড়ির দখল ও অবস্থানের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে হাইকোর্ট। জেলা প্রশাসনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত থেকেও এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবে আদালতের আদেশের পরও ওই জায়গায় দখলদার এম ফরিদ চৌধুরীর লোকজন সার্বক্ষণিক অবস্থান শুরু করেন।

গত ৯ জানুয়ারি বাড়িটি পরিদর্শনে যান স্থানীয় সাংসদ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বাড়িটি ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করবেন বলে জানান। একইদিন বাড়ির সামনে সমাবেশ করে ১০ দিনের আলটিমেটাম দিয়ে আমরণ অনশন শুরুর ঘোষণা দেন রানা দাশগুপ্ত।

এর আগে আবুল মোমেন ও রানা দাশগুপ্ত বাড়িটি রাষ্ট্রের দখলে নিয়ে সেখানে জাদুঘর তৈরির দাবি জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনকে স্মারকলিপি দেন। চসিক প্রশাসক সেখানে জাদুঘর তৈরির প্রস্তাবনা পাঠান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

এরপর গত ২১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ এবং দফতর সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে সেটি রক্ষায় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

তবে ৪ জানুয়ারির পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠন।

সারাবাংলা/আরডি/এমআই

দেশপ্রিয় দেশপ্রিয়য় বাড়ি দখন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর