ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের সূচনা হলো বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে একদম শুরুতে ভ্যাকসিন নিয়েছেন পাঁচ জন। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার এই পাঁচ নাগরিক ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অন্যদেরও ভ্যাকসিন নিতে উৎসাহিত করেছেন। আর ভ্যাকসিন নিয়ে তারা বাকিদের উদ্দীপ্ত করেছেন ইতিহাসের গৌরবময় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বলে।
ভ্যাকসিন প্রয়োগের গোটা সময়েই গণভবন থেকে যুক্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সবাইকে অভয় দিয়েছেন। সাহসী হয়ে প্রথম দফায় ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য জানিয়েছেন আন্তরিক অভিবাদন।
বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন-
- ভ্যাকসিন প্রয়োগে প্রস্তুত ৫ হাসপাতাল
- এ ভ্যাকসিন সবচেয়ে নিরাপদ: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
- প্রথম যে ৫ জন পেলেন করোনার ভ্যাকসিন
- দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু
- ‘ভ্যাকসিন নিতে ব্যথা পাইনি, খারাপও লাগছে না’
- ‘লক্ষ্য ছিল জনগণের সুরক্ষা, সেভাবেই ভ্যাকসিন পেয়েছি’
- ‘ভালো না লাগা’ রোগের ভ্যাকসিন আছে কি না জানি না: প্রধানমন্ত্রী
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ঘোষণার পরে সবার আগে ভ্যাকসিন নেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। এরপর একে একে ভ্যাকসিন নেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. আহমেদ লুৎফর মবিন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক, মতিঝিল বিভাগের সদস্য দিদারুল ইসলাম এবং সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম ইমরান হামিদ। ভ্যাকসিন নেওয়া শেষ করে তারা সবাই স্লোগান দেন ‘জয় বাংলা’ বলে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য সবাই যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল ক্ষেত্রেই এই স্লোগান দিয়েই অংশগ্রহণ করেছেন দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
তিনি বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্ব কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য। এটি এক ধরনের মানবিক যুদ্ধ, যেখানে আসলে বিজ্ঞানের সাহায্যে আমাদের জয়ী হওয়ার চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে। আর তাই ভ্যাকসিন গ্রহণ শেষে সবাই স্লোগান দিয়ে বলেছে ‘জয় বাংলা’। কারণ এটি সবাইকে উদ্দীপ্ত করবে।
প্রথম ৫ জনের ভ্যাকসিন নেওয়ার মুহূর্ত
প্রথম ভ্যাকসিন গ্রহীতা রুনু ভোরোনিকা কস্তা প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুভ অপরাহ্ন।’ এসময় গণভবন প্রান্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমার ভয় লাগছে না তো? ভয় পাচ্ছো না তো?’ জবাবে রুনু বলেন, ‘না, ম্যাডাম।’ প্রধানমন্ত্রী এসময় বলেন, ‘খুব সাহসী তুমি।’
ভ্যাকসিন প্রয়োগ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হয়ে গেল? রুনু, তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তুমি ভালো থাকো, সুস্থ থাকো। আরও অনেক রোগীর সেবা করো, সেই দোয়া করি।’
এসময় রুনু ভেরোনিকা কস্তা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। প্রধানমন্ত্রীও তার জবাবে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান ধরেন।
এরপর একই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আহমেদ লুৎফুল মোবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম দিয়ে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য নির্ধারিত স্থানে বসেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী তাকে শুভকামনা জানান। তার ভ্যাকসিন নেওয়া শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমাকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা। তুমি সুস্থ থাকো, ভালো থাকো।’ পরে ডা. মোবেনও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন।
তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে ভ্যাকসিন নিতে আসেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। প্রধানমন্ত্রী তাকে শুভেচ্ছা জানান। একইসঙ্গে জিজ্ঞাসাও করেন— ‘নার্ভাস লাগছে না তো!’ ভ্যাকসিন প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হলে সাহস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাসল রিল্যাক্স করতে হবে।’
ভ্যাকসিন নেওয়া শেষ হলে ডা. নাসিমা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে আছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।’
চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম ভ্যাকসিন নিতে আসেন। তিনি সালাম জানালে জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের পুলিশ কিন্তু অনেক কাজ করেছে। এবার (করোনা সংক্রমণের সময়) পুলিশ এত সার্ভিস দিয়েছে, তা বলার মতো না। অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।’
পরে দিদারুল ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী তাকেও জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভয় লাগছে না তো? ঠিক আছো?’ দিদরুল ‘ঠিক আছি’ বললে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটু কথা বলে রিল্যাক্স করে নেই।’ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শেষে আবার তিনি ভ্যাকসিন প্রয়োগে যুক্তদের উদ্দেশে বলেন, ‘একটু ম্যাসাজ করে নিলে ভালো হবে।’
ভ্যাকসিন নেওয়া শেষ দিদারুল ইসলাম ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একটু সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। দেশ ও জনগণের সেবক হিসেবে নিজে ভ্যাকসিন নিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে সবার শেষে ভ্যাকসিন নিতে আসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম ইমরান হামিদ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সালাম বিনিময় করলে প্রধানমন্ত্রী তার উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি নিচ্ছো?’ সেনা কর্মকর্তা ইতিবাচক উত্তর দিলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ও আচ্ছা।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভয় পাচ্ছ, ইমরান?’ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শেষ হলে তিনি বলেন, ‘হয়ে গেল? ঠিক আছে?‘
প্রধানমন্ত্রী এসময় নিজের ভ্যাকসিন গ্রহণের আগ্রহের কথা জানিয়ে বলেন, ‘এখন তো মনে হচ্ছে আমরাও (ভ্যাকসিন) নিয়ে আসি।’ পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘আগে নিলে আবার বলবে যে নিজেই আগে নিল, কাউকে দিলো না। সবাইকে দিয়ে নেই, তারপর নেব।’
এসময় এম ইমরান ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রীকে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক ধন্যবাদ। দোয়া করি— সুস্থ থাকো, ভালো থাকো।’
এসময় করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমের শুরুর ক্ষণটিকে দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হিসেবে অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ‘ভ্যাকসিন হিরোদে’র ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশও এখনো ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করতে পারেনি। সেখানে আমাদের মতো একটি দেশ, ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, সীমিত অর্থনৈতিক শক্তি নিয়েও আমরা যে মানুষের কল্যাণে কাজ করি, সেটাই আজ প্রমাণ হলো।’
প্রধানমন্ত্রী সবার সুস্থতা কামনা করে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, এই অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাব। বাংলাদেশ আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হয়ে গড়ে উঠবে।’