প্রধানমন্ত্রীকে দেখে সব ভয় কেটে গেছে— রুনু ভেরোনিকা কস্তা
২৭ জানুয়ারি ২০২১ ২১:২৩
ঢাকা: দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়েছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা। পূর্বঘোষণা ছিল বলে তার এই ভ্যাকসিন গ্রহণের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সারাদেশের। ওদিকে সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবার সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন রুনুকে ভ্যাকসিনটি দেওয়া হলো, প্রধানমন্ত্রী নিজেই হাত তালি দিয়ে উঠলেন। প্রশংসা করলেন রুনু ভেরোনিকার সাহসের।
কিন্তু যার দিকে সারাদেশের দৃষ্টি— সেই রুনু ভেরোনিকার মনের মধ্যে কী খেলা করছিল? ভ্যাকসিন নেওয়ার পর পর্যবেক্ষণের সময় শেষে সারাবাংলার সঙ্গে কথপোকথনে রুনু বলছেন, খানিকটা ভয় কাজ করছিলই ভেতরে ভেতরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে পেয়ে তার সেই ভয় একেবারেই কেটে গেছে। কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়াই ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রক্রিয়াটি শেষ করে গর্বও অনুভব করছেন তিনি।
বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেল ঠিক ৪টা ৮ মিনিটে রুনু ভেরোনিকা কস্তার শরীরে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করতে পারল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে রুনুই যে করোনার ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছেন, সেটি জানা গিয়েছিল আগেই। তিনি নিজেই সারাবাংলাকে জানিয়েছিলেন, ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেকের মধ্যেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই তিনি ভ্যাকসিন নিতে চান। সে অনুযায়ী মানসিক প্রস্তুতিও ছিল বলে জানিয়েছিলেন।
কিন্তু সত্যি সত্যিই কি ভ্যাকসিন নেওয়ার সময় কোনো ধরনের নার্ভাসনেস কাজ করেনি?— ভ্যাকসিন নিয়ে পর্যবেক্ষণের সময় পেরিয়ে তার সাক্ষাৎ পাওয়া গেলে সারাবাংলার পক্ষ থেকে জানতে চাই এই প্রশ্ন।
জবাবে রুনু বলেন, অনেকের অনেক ধরনের কথাবার্তা শোনার পরে কিছুটা নার্ভাস লাগছিল। এটা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সামনে দেখে সব ভয় কেটে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সামনে আমিই দেশে প্রথম ভ্যাকসিন নিতে পেরেছি— এটা ভেবে খুব ভালো লাগছিল। ভ্যাকসিন দেওয়া শেষে গর্বিত মনে হচ্ছিল।
আরও পড়ুন-
- ভ্যাকসিন প্রয়োগে প্রস্তুত ৫ হাসপাতাল
- এ ভ্যাকসিন সবচেয়ে নিরাপদ: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
- প্রথম যে ৫ জন পেলেন করোনার ভ্যাকসিন
- দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু
- ‘ভ্যাকসিন নিতে ব্যথা পাইনি, খারাপও লাগছে না’
- ‘লক্ষ্য ছিল জনগণের সুরক্ষা, সেভাবেই ভ্যাকসিন পেয়েছি’
- ‘জয় বাংলা’য় উজ্জীবিত ভ্যাকসিন হিরোরা, প্রধানমন্ত্রীর অভিবাদন
- ‘ভালো না লাগা’ রোগের ভ্যাকসিন আছে কি না জানি না: প্রধানমন্ত্রী
- জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেই ভ্যাকসিন নিয়েছি— ট্রাফিক সার্জেন্ট দিদারুল
বুধবার বিকেলে আসে সেই ক্ষণটি। কুর্মিটোলা হাসপাতাল প্রান্তে উপস্থিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বক্তব্যের পর বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বক্তব্য শেষে তিনি ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এরপরই রুনুকে নিয়ে যাওয়া হয় ভ্যাকসিন প্রয়োগের স্থানটিতে। সেখানেও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কথা বলেছেন ভ্যাকসিন গ্রহীতা সবার সঙ্গে, সাহস দিয়েছেন।
প্রথম ভ্যাকসিন গ্রহীতা রুনু ভোরোনিকা কস্তা প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুভ অপরাহ্ন।’ এসময় গণভবন প্রান্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তোমার ভয় লাগছে না তো? ভয় পাচ্ছো না তো?’ জবাবে রুনু বলেন, ‘না, ম্যাডাম।’ প্রধানমন্ত্রী এসময় বলেন, ‘খুব সাহসী তুমি।’
ভ্যাকসিন প্রয়োগ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হয়ে গেল? রুনু, তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তুমি ভালো থাকো, সুস্থ থাকো। আরও অনেক রোগীর সেবা করো, সেই দোয়া করি।’
এসময় রুনু ভেরোনিকা কস্তা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। প্রধানমন্ত্রীও তার জবাবে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান ধরেন।
ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে বলে জানালেন রুনু। তিনি বলেন, ‘জয় বাংলা’ তো আমাদের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের স্লোগান। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার এটি ছিল প্রাণের স্লোগান। তারা ‘জয় বাংলা’ বলেই বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করতেন।
রুনু বলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের এনে দেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে আজ আমাদেরও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ঠিক এই কথাটিই মনে হচ্ছিল। সে কারণে মনের আনন্দেই ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলাম।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের এই সিনিয়র স্টাফ নার্স জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কাজ করছেন। মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে নার্সিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেওয়া রুনু এর আগে ইউনাইটেড হাসপাতালে কাজ করতেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরুর এই দিনটিকে এক ঐতিহাসিক দিন বলে অভিহিত করেন। আর এই দিনটিতে দেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে একইভাবে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন রুনু ভেরোনিকা কস্তা। তিনি বলেন, আজ ভ্যাকসিন নেওয়ার মাধ্যমে একটি ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি। এ এক অন্যরকম আনন্দের অনুভূতি। এর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা হবে না।
রুনু ভেরোনিকা কস্তার সন্তান দুইটি— ১৩ বছর বয়সী প্রথা গোমেজ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, ৯ বছর বয়সী প্রয়াস গোমেজ তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ভ্যাকসিন নেওয়ার সিদ্ধান্তে নিজে অটল থাকলেও মা হিসেবে কিছু হলেও উদ্বেগে ছিলেন রুনু। তিনি বলেন, বাচ্চারা খুব উৎসাহ নিয়ে বলেছিল, মা সবার আগে ভ্যাকসিন পাবে। তবে সকালে আসার সময় একটু কেমন লাগছিল। দেশের জন্য কাজ করছি, কিন্তু হাজার হলেও আমি তো মা। যদি কিছু একটা হয়ে যায়— এমন একটু মনে হচ্ছিল। গাড়িতে ওঠার পর ছেলেটাকে যখন বুকে নিলাম, তখন একটু কান্নাও পাচ্ছিল।
স্বামী পবন গোমেজের কাছ থেকে অবশ্য বরাবর সমর্থন পেয়েছেন রুনু ভেরোনিকা কস্তা। তিনি বলেন, আমার স্বামী শোনার পর থেকেই বলেছে— ‘কে কী বলছে, কিছুই ভাবার দরকার নেই। তোমার পেশাই তো মানবজাতির সেবা করা। তাই তুমি ভ্যাকসিন নিলে বাকিরা উদ্বুদ্ধ হবে। প্রধানমন্ত্রীও যখন বলেছেন, উনার ইচ্ছা একজন নার্সকে দিয়েই ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু করা, তখন আর ভাবনার কারণ নেই। বিপদজনক কিছু হলে উনি নিশ্চয়ই সেটা চাইতেন না।’ ওর কথা শুনেই আরও সাহস পেয়েছি।
কুর্মিটোলা হাসপাতালে এদিন স্ত্রীর পাশেই ছিলেন পবন গোমেজ। তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমি যখন প্রথম শুনি যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রুনুকে বলেছে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য, আমি তখনই রাজি হয়ে যাই। আমিই ওকে বলি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য। হ্যাঁ, অনেকে অনেক কথা বলেছে। কিন্তু আমি ভয় পাইনি।
তিনি বলেন, পেশাগত দিক তিনি রুনু এমন এক স্থানে আছে যেখান থেকে পিছুপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি শুধু মনে করেছি, ও ভ্যাকসিন নিলে এতে সারাদেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে, মানুষের ভালো হবে। পুরো বিশ্ব আসলে এই করোনা নিয়ে বিপর্যস্ত। এক্ষেত্রে রুনুকে ভ্যাকসিন নিতে দেখে যদি আমাদের দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, তবে সেটা আমার অবশ্যই ভালো লাগবে। সব মিলিয়ে আসলে দেশের মানুষের কথা ভেবেই আমি রাজি হয়ে যাই।
রুনুর পর একই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আহমেদ লুৎফুল মোবেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক মতিঝিল বিভাগের কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম ইমরান হামিদকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। পুরো সময়টায় ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত থেকে ভ্যাকসিন গ্রহীতা প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের সবাইকে তিনি অভিবাদন ও ধন্যবাদ জানান।
পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালেই বিভিন্ন শ্রেণিপেশার আরও ২১ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এ নিয়ে প্রথম এই দিনটিতে মোট ২৬ জন ভ্যাকসিন পেলেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) এই হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হবে। একেকটি হাসপাতাল চার থেকে পাঁচশ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর একসপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করা হবে। এরপর সারাদেশে শুরু হবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্যাকসিন গ্রহীতা ভ্যাকসিন প্রয়োগ রুনু ভেরোনিকা কস্তা