অরণ্যের অগ্নিশিখা
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১১:৫২
পলাশের নেশা তীব্র, বসন্তে ফোটা পলাশ বনে ঘোর লাগে। তবে বড় ক্ষণস্থায়ী পলাশের মৌসুম। মাত্র কুড়ি-পঁচিশ দিন। নেশা লাগতে লাগতে, চিনে নিতে নিতে সে উধাও হয়ে যায়। যৌবনের উন্মাদনার মতো ক্ষণস্থায়ী। তবে এই ক্ষণস্থায়ী সুখ চলে গেলেও স্মৃতি থেকে যায়। সেই স্মৃতি নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি অন্য বসন্তের…
পলাশের গুণগানে বাংলা ও সংস্কৃত বাক্য মুখর। সংস্কৃতে এর নাম কিংশুক, বাংলায় পলাশ। বাংলাতে পলাশকে কোথাও কোথাও ধাক বা ঢাক বলে। উজ্জ্বল প্রস্ফুটনের জন্যই পলাশের ইংরেজি নাম ‘ফ্লেইম অব দ্য ফরেস্ট’ বা অরণ্যের অগ্নিশিখা।
পলাশ নিয়ে আছে আনেক গল্পও। যেমন— পুরাকালে বারাণসী নগরের বাইরে ছিল এক কাঠুরে। সে বন থেকে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতো। সে সময় হিমবন্ত অঞ্চলে এক বিশাল পলাশ গাছেন নিচে এক কালো সিহং বিশ্রাম নিতো। একদিন ঝড়ে পলাশের একটি শুকনো ডাল সিংহের গায়ে ভেঙে পড়ে। সিংহ কাঁধে একটু ব্যথা পেলেও কোনো মতে রক্ষা পায়। সে তখন ভাবলো, এই পলাশ গাছ চায় না, আমি তার নিচে বিশ্রাম নিই। সে তখন পলাশ গাছের প্রতি ক্রদ্ধ হয়ে তার সর্বনাশের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে।
এ সময় সেই কাঠুরে দুই তিন জন সঙ্গীসহ রথ তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে সেখানে পৌঁছালো। তাদের দেখে সিংহ ভাবলো, এখন আমার শত্রু নিধন করার সময় এসেছে। সিংহ তখন পলাশ গাছের কাছে দাঁড়িয়ে কাঠুরেকে বললো, হে কাঠুরে, কী কাঠ তিমি কাটকে চাও?
সিংহের কথা শুনে কাঠুরে অবাক হয়ে বললো, তুমি বনের রাজা, পশুর রাজা, তুমি বলো রথের জন্য কোন কাঠ ভালো হয়।
সিংহ তখন বললো, ‘ধর ত অধম; শাল, খদির ইত্যাদি- শক্তকাঠ এদের, আছে এই খ্যাতি।
পলাশের কাছে কিন্তু এরা কিছু নয়। পলাশ কাঠের চাকা চিরস্থায়ী হয়।’
সিংহের কথামতো কাঠুরে পলাশ গাছ চিনে নিয়ে কাঠতে শুরু করলো। এমন সময় বৃক্ষদেবতা ভাবলো, আমি ইচ্ছে করে সিংহের গায়ে ডাল ফেলিনি। তবুও সে আমার প্রতি ঈর্ষা ও রাগবশত ক্ষতি করতে উদ্যত।
তখন বৃক্ষদেবতা বললো, হে কাঠুরে, পলাশ গাছ দিয়ে রথের চাকা বানাবে ভালো কথা। কিন্তু তোমার রথের চাকা আরও বেশি মজবুত হবে যদি তুমি ওই চাকার গায়ে কালো সিংহের চামড়া মুড়িয়ে দিতে পার। কাঠুরে বঝলো শুভ দিনে সে গাছ কাটতে এসেছে। পলাশ গাছও পেল, সিংহও কাছে বসে আছে। তাই কাঠ কেটে, সিংহকে মেরে তার চামড়া নিয়ে ঘরে চলে গেল।
এই কাহিনীর জাতকটির নাম ‘স্পন্দন জাতক’। এই কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি সেই আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয় অঞ্চলে পলাশ গাছ ছিল এবং জনগণের কাছে পরিচিত ছিল।
পলাশের বর্ননায় আরও বলা হয়েছে, কামের বন্ধু বসন্ত যখন পৃথিবীতে আসে, তখন নির্গন্ধ ফুলের গাছ পলাশেও রঙ ধরায়। সেই রঙও যেমন তেমন নয়, কামনার মতো লালে লাল।
কবিও বলেছেন, ‘মদনের আঘাতে ব্যাকুল হয়ে প্রস্ফুট যৌবনে বক্ষের কমল স্পর্শে করস্পর্শ করার পর মধু আহরণের শেষ পর্বে বাঁকা চাঁদের মতো যে দাঁতের দাগ রেখে যায়, তা ঠিক যেন পলাশ ফুলের ছাপ।’
সংস্কৃত কবির কথা তো গেল, রবীন্দ্রনাথ গানে লিখেছেন তার চেয়ে কম নয়-
কুঞ্জবনের অঞ্জলি যে ছড়িয়ে পড়ে
পলাশ কানন ধৈর্য হারায় রঙের ঝড়ে,
বেণুর শাখা তালে মাতাল পাতার নাচে।
বাংলাদেশের গ্রামে ও শহরে সব জায়গায় পলাশ ফুল দেখতে পাওয়া যায়। ফাল্গেুনে গাছের পাতা ঝরে, আর তখনই ফলের কুঁড়ি আসে দলে দলে এবং গুচ্ছে গুচ্ছে। ফাগুন শেষ না হতেই ফুল ফুঁটে শেষ হয়ে যায়। ভরা মৌসুমে তার আগুনঝরা রূপ উপচে পড়ে। দুপুরে সূর্যের আলো পলাশ বনে পড়লে আগুনের উৎসব শুরু হয়ে যায়। চোখ ধাঁধাঁনো সেই রং দেখে মনে হয় বসন্ত যেন পলাশেই শুধু ভর করেছে। মানুষের মনেও সেই রাগ তখন সঞ্চারিত হয়। ব্যকুলতা-বিহ্বলতা-মত্ততা তখন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পলাশ গাছ তখন থাকে উলঙ্গ, উলঙ্গ গাছে তখন ফোটে কামনার রঙের থোকা থোকা ফুল। সেই কামনায় মৌমাছিরা ভিড় জমায় ডালে ডালে।
পলাশের ফুলের রং তিন রকম- হলুদ, লাল ও লালচে কমলা রঙ। সরু ডালের মাথায় এই কুঁড়ি থরে থরে সাজানো থাকে। বকফুলের মতো তার গঠন। ডালের গোড়ায় দিক থেকে ফুটতে ফুটতে আগার দিকে যায়।
ফোটার আগে গায়ের ওপর রোমশ কালো একটা আবরণ থাকে। রাজ্যের পিঁপড়ে সেখানে জমা হয়। আর ফুল ফোটার শেষে সবুজ পাত এসে তখন লাল কামনার রঙ ধুয়ে মুছে দেয়। মাত্র দুদশ দিন আগের আগুন ঝরা রূপের কথা মনে থাকলেও সিন্ধ সবুজ রং সব কিছু হটিয়ে দেয়।
পলাশ মাঝারি ধরনের গাছ। গোড়া কাটা কাটা হলেও শাখা-প্রশাখা বেশ মসৃণ। ডাল মোটাসোটা হয় না। গাছ ২০-৩০ ফুট উঁচু হয়। কয়েখটি শাখা নিয়ে মোটামুটি ছড়িয়ে পড়া ডালপালার গাছ। একটি মূল বৃন্তে তিনটি পাতা। পাতা মাঝারি ধরনের বড় এবং শিরাযুক্ত। পলতে মাদারের পাতার পড় সংস্করণ বলা যায়। ফুলের আধারের গা ভেলভেটের মতো নরম ও পুরু। ফল চ্যাপ্টা, অনেকটা ছোট শিমের মতো। এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা। একবীজীয় রোমশ শিরাচিহ্নিত, প্রথমে সবুজ এবং পরে হালকা হলুদ কিংবা পাশুটে, পাতলা, বায়ুবাহী।
কাঠ নরম, তাই আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ছাল, পাতা, ফুল, বীজ ও গাছের আঠা ওষুধে ব্যবহৃত হয়। লাবণ্য রক্ষায়, পেটরোগা রোগে, ক্রিমির পেট ব্যথায়, রাতের ঘামে, বারবার প্রস্রাবে এমন কি পুত্র সন্তান লাভের আশায় এর লোকায়ত ব্যবহার হয়। এছাড়া বিছের কামড়ে, গায়েল জ্বালায় হাইড্রোসিলের রোগে এর ব্যবহার করা হয়।
হিন্দুদের কাছে গাছটি অত্যন্ত পবিত্র। এর কাঠ হোম ও উপনয়ন অনুষ্ঠানের উপকরণ। হিন্দু ধর্মমতে ওর ত্রিপত্র ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের প্রতীক।
পলাশের পরাগায়নের মাধ্যম মূলত পাখি। বীজ সহজে অঙ্কুরিত হয় কিন্তু বৃদ্ধি মন্থর।
ছবি: সুমিত আহমেদ
সূত্র: ঋতু পিডিয়া
সারাবাংলা/এমআই