ঢাকা: গাজীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার বিচার গতিহীন হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে মামলার বিচারকাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও এখনও চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত ১১ আসামির সাজা বাড়ানোর জন্য করা আপিল আবেদন সাময়িকভাবে কার্যতালিকা (কজলিস্ট) থেকে বাদ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে আলোচিত এ মামলাটি আবারও ঝুঁলে গেল।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, আপিল বিভাগ সাময়িকভাবে আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলাটি কার্যতালিকা (কজলিস্ট) থেকে বাদ দিয়েছেন। পরবর্তীতে এটি আবারও কার্যতালিকায় আসবে। তবে কবে, কোন তারিখে আসবে সেটি তিনি জানাতে পারেননি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এ মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষ কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। কবে আবার মামলাটি শুনানির জন্য আসবে, সেটি আদালতের বিষয়। আমি বলতে পারব না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি হাইকোর্টে থাকাকালে এই মামলার জজ (বিচারক) ছিলেন। আপিলের আরেক বিচারপতি হাইকোর্টে এই মামলার শুনানিতে ছিলেন। যেহেতু তারা এখন আপিল বিভাগের বিচারপতি। তাই আইনগতভাবে তারা মামলাটি শুনতে পারবেন না। তারা এ মামলাটির শুনানি থেকে বিরত থাকবেন। এ কারণে আপিল বিভাগ মামলাটি আপাতত কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। পরবর্তীতে নতুন বেঞ্চ গঠনের পর মামলাটির শুনানি হতে পারে।
এর আগে ২০১৬ সালের ১৫ জুন আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়। আটজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় (যাদের বিচারিক আদালতে ফাঁসি হয়েছিল)। একজনের বিচারিক আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এ মামলার মোট ৩০ আসামির মধ্যে দুজন বিচারিক আদালতেই খালাস পেয়েছিলেন। তারা হলেন, কবির হোসেন ও আবু হায়দার ওরফে মিরপুরইয়া বাবু। আর বিচারিক আদালতে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়ার পর মৃত্যুবরণ করায় আল আমিন ও রতন ওরফে ছোট রতনের আপিলের নিষ্পত্তি করে দেন হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতে দণ্ড পাওয়া জীবিত বাকি ২৬ আসামির মধ্যে বর্তমানে ১৭ জন কারাগারে ও ৯ জন পলাতক রয়েছেন।
এদের মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে সাতজনের বিচারিক আদালতের দেওয়া ফাঁসির সাজা কমেছে এবং বাকি একজনের আগের সাজাই বহাল রয়েছে। এছাড়াও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অহিদুল ইসলাম টিপু পলাতক থাকায় তার সাজার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আদালত।
হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ছয়জন হলেন- নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ ও সোহাগ ওরফে সরু।
মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাতজন হলেন- মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় রতন, ছোট জাহাঙ্গীর (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম ওমশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক)। এবং যাবজ্জীবন সাজা বহাল থাকা আসামি হলেন নুরুল আমিন।
বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পাওয়া ওই ১১ আসামি হলেন- আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া, রাকিব উদ্দিন সরকার পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর ও মনির।
২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার পরদিন আহসান উল্লাহ মাস্টারের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এরপর এ মামলার তদন্ত, চার্জ গঠন ও যুক্তিতর্ক শেষে ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক আদালত ৩০ জন আসামির মধ্যে বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশসহ দুজনকে খালাস দেন। এসব আসামিদের মধ্যে ১৭ জন কারাগারে ও ৯ জন পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া দুজন মারা গেছেন।
পরে বিচারিক আদালতের রায়ের বিষয়ে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল হয়।
এরপর ২০১৬ সালের ১৫ জুন হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে। ওই রায়ে ৬ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয়। ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় (যাদের বিচারিক আদালতে ফাঁসি হয়েছিল)। একজনের বিচারিক আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি বাকি ১১ জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। পরে হাইকোর্টের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত ১১ জনের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। তারপর গত ৭ জানুয়ারি মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকা থেকে বাদ পড়ে।