Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চোরাচালানে ধরা পড়া সোনার ৭৩ ভাগই বাংলাদেশ বিমানের

শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৩:১১

ঢাকা: সোনা চোরাচালানের নিরাপদ মাধ্যম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বিভিন্ন সময়ে সোনার যত বড় চালান ধরা পড়েছে তার ৭৩ ভাগই বাংলাদেশ বিমানের। গোয়েন্দাদের অভিযোগ, বিমানকর্মীদের সহযোগিতা ছাড়া উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ খুলে সোনা লুকিয়ে রেখে পাচার করা সম্ভব নয়।

চোরাচালান বন্ধে এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৭৭ এর বিমান থেকে যাত্রীদের মালামাল রাখার স্থান (কার্গো হোল) থেকে ১৪ কেজি সোনা উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। কালো কাপড়ে সেলাই করে সেখানে সোনার বারগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু যেখানে সোনার বারগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো সেগুলো কখনও সাধারণ যাত্রীর পক্ষে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

ঘটনার পরদিন ১৫ জানুয়ারি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল হোসেন বাদী হয়ে দু’জনের নাম উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। ওই দু’জন হলেন বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক এমরানুল ইসলাম ও ওসমান গনি। মামলায় বলা হয়, ‘উড়োজাহাজের টয়লেটের নিচ বরাবর কার্গো হোলের উড়োজাহাজের বডিসংলগ্ন প্লাস্টিকের প্যানেল খুলে ওই সোনা জব্দ করা হয়। আসামি এমরানুল ও ওসমান সংঘবদ্ধ চক্রের অন্য সদস্যদের সহায়তায় সোনা বাইরে পাচার করতেন।’

বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিবন্ধন খাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সে সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এমরানুল। তাকে তখন বিমানের প্রধান প্রকৌশলীর কক্ষে হাজির হতে বলা হয়। এরপর তাকে মোবাইল ফোনে ডাকা হয়। কিন্তু সেদিন তিনি সেখানে হাজির হননি।

বিজ্ঞাপন

এরপর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ১২৪ কেজি সোনার সবচেয়ে বড় চালানটি বাংলাদেশ বিমানেই এসেছিল। এছাড়া ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় আসা বাংলাদেশ বিমানের (বিজি ০২৬) একটি ফ্লাইটে অভিযান চালানো হয়। বাংলাদেশ বিমানের সিটের নিচ থেকে তখন সাড়ে সাত কেজি ওজনের স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ৬৪ কেজি সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কাঠের চারটি ক্যারেটের কাঠামোর মধ্যে  লুকিয়ে রাখা সোনার বার পাওয়া যায়। এই সোনাগুলো ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেই (বিজি০৮৫) ঢাকা আসে।

অপরদিকে, ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৭ কেজি ১৯০ গ্রাম সোনাসহ বিমানকর্মীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একইসঙ্গে বিমানটিও জব্দ করা হয়। সেদিন দুবাই থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটের (বিজি০৪৮) সিটের নিচে রাখা ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনার বার পাওয়া যায়। একইদিনে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বহিরাংশসংলগ্ন রানওয়ে এলাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টেকনিক্যাল হেলপার মেহেদি হাসানের কাছ থেকে ২ কেজি ৫৫০ গ্রাম সোনা পাওয়া যায়।

আর ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর আবুধাবি থেকে আসা বিমানের একটি উড়োজাহাজ থেকে ৮ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। উড়োজাহাজটির সিটের নিচের পাইপের মধ্যে এসব সোনা লুকানো ছিল। এ ঘটনায়ও উড়োজাহাজটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস।

এর আগে, ২০১৯ সালের ১৩ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেটের কাছ থেকে বিমানের  ট্রাফিক হেল্পার এমদাদ হোসেন চৌধুরী ও তার সহযোগী আব্দুর রহিমকে ৪ কেজি সোনাসহ আটক করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে সোনা চোরাচালানের দায়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা জরিমানাও করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একইসঙ্গে চোরাচালানের পণ্য বহনের দায়ে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্ত করে কাস্টমস। তবে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দিয়েছিল কাস্টমস।

—এভাবে বাংলাদেশ বিমানের এমন অসংখ্য ফ্লাইট থেকে সোনা উদ্ধার করেছে কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সাধারণত বিমান উড্ডয়নের ৩০ মিনিট আগে সব যাত্রীকে একসাথে বিমানের উঠানো হয়। ফলে কোনো যাত্রীর পক্ষে বিমানের ভেতরে সোনা লুকানো সম্ভব নয়। ফলে গোয়েন্দারা আশংকা করছেন, বিমানের কোনো না কোনো কর্মকর্তার সহযোগিতায় বিমানের ভেতরে সোনা লুকিয়ে রাখা হয়, এরপর সেগুলো পাচার হয়ে থাকে। আর এসব বিষয় উল্লেখ করে গত বছরের আগস্টে নিরাপদ তদন্ত চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি লেখে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

শুল্ক গোয়েন্দার হিসাবে, আটকের চেয়ে সোনা চোরাচালান হয়েছে অনেক বেশি। আবার সোনা উদ্ধারে বেশিরভাগ সময়ই সহযোগিতা পাওয়া যায় না বিমানের। ধরা পড়লেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না বিমান কতৃপক্ষ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে বড় সোনার চালান ধরা পড়েছে ২২টি। যার মধ্যে ১৬টিই হলো বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট। আর জব্দ করা হয়েছে ২৪০ কেজি সোনা।

এসব বিষয় জানতে বাংলাদেশ বিমানের ডিজিএম তাহেরা খন্দকারকে (জনসংযোগ) মোবাইলে বেশ কয়েকবার কল দেওয়া হলেও ফোনটি তিনি রিসিভ করেননি।

এমনকি বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. মোকাব্বির হোসেনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনিও কল রিসিভ করেননি।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘সোনা চোরাচালানের সঙ্গে অনেক অবৈধ কাজ জড়িত। এর পেছনে অনেক কাজ হয়। খুব কম পরিমাণ সোনা দিয়ে অনেক বড় বড় কাজ করা যায়। যার প্রদর্শনও খুব কম। ফলে অবৈধ কাজে সোনা বেশি ব্যবহার হয়।’

সারাবাংলা/এসজে/এমও

বাংলাদেশ বিমান সোনা চোরাচালান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর