দেশের প্রথম মেট্রোরেল: ফুরিয়ে আসছে অপেক্ষার দিন
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:০০
মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকা থেকে ফিরে: রাজধানীবাসীকে যানজটের কবল থেকে মুক্তি দেওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রজেক্ট মেট্রোরেল। রাজধানীজুড়ে ধাপে ধাপে বেশ কয়েকটি মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে প্রথম মেট্রোরেল হিসেবে উত্তরা-কমলাপুর রুটে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে এলমআরটি লাইন-৬। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, প্রথম এই মেট্রোরেল চালু নিয়ে রাজধানীবাসীর অপেক্ষার দিন ফুরোতে যাচ্ছে। পুরোটা পথ না হলেও আগামী ১৬ ডিসেম্বরেই এই রুটের প্রথম অংশটি (উত্তরা-আগারগাঁও) চালু করতে এখন প্রকল্প এলাকায় চলছে বিশাল কর্মষজ্ঞ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কোনো ব্যয় না বাড়িয়ে নির্ধারিত মেয়াদের দুই বছর আগেই তারা প্রথম এই মেট্রোরেলটি চালুর স্বপ্ন দেখছেন। তারা জানালেন, আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি জাপান থেকে রেলের কোচ বাংলাদেশের পথে রওনা দেবে। সেগুলো আগামী ২৩ এপ্রিল পৌঁছাবে উত্তরা ডিপোতে। জুলাই মাসে শুরু হবে ট্রায়াল রান। পাঁচটি স্টেশনের মধ্যে এই পরীক্ষামূলক রেল চলাচলের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) উত্তরা ডিপোসহ মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায় অগ্রগতির চিত্র। দৃশ্যমান এ প্রকল্পটিতে কোভিড-১৯ কিছুটা আঘাত হানলেও তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সেই ধাক্কা সামাল দিয়েই পুরোদমে এগিয়ে চলছে মেট্রোরেলের কাজ।
সরেজমিন ঘুরে দেখার সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানালেন, ২০১২ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫ হাজার ৩৯০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণ থেকে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রথম অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৮০ দশমিক ২১ শতাংশ। এছাড়া মতিঝিল পর্যন্ত পুরো এমআরটি লাইন-৬-এর অগ্রগতি ৫১ দশমিক ২৬ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল সিস্টেম, রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইক্যুইপমেন্ট কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৪৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সবশেষ মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত অংশের হাউজহোল্ড সার্ভে ও সোস্যাল স্টাডির কাজও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, প্রতিটি স্টেশনে রেল গাড়ি দাঁড়াবে ৪৫ সেকেন্ড। একেকটি বগিতে থাকবে ৫৪ জনের বসার ব্যবস্থা। পিক আওয়ারে (অফিস যাওয়া ও আসার সময়) একেকটি ট্রিপে বসে ও দাঁড়িয়ে মোট ২ হাজার ৩০৮ জন যাতায়াত করতে পারবেন। আর অফপিক আওয়ারে একেক ট্রিপের যাত্রী ধারণক্ষমতা হবে এক হাজার ৭৩৮ জন। প্রতিটি ট্রেনে নারীদের জন্য থাকবে একটি করে বিশেষ বগি। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিটি বগির দরজার পাশে হুইল চেয়ার আটকানোর ব্যবস্থাও থাকবে।
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকায় দেখা যায়, মেট্রোরেলের ডিপোতে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে তৈরি হচ্ছে ৫২টি স্থাপনা। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ স্থাপনার কাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো কাজও ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। ট্রেন পরিচালনার জন্য ১৫শ ভোল্টের বিদ্যুৎ রিসিভিং স্টেশন নির্মাণের কাজও শেষ।
এখানেই রয়েছে বিশালাকৃতির এক ওয়ার্কশপ, যেখানে প্রতিদিন চলাচল শেষে ট্রেনগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। কোনো ধরনের ত্রুটি পেলে সেগুলো সারাই করে তারপর ফের চলার জন্য ছাড়া যাবে। এই ওয়ার্কশপে একসঙ্গে ২৪টি ট্রেনের মেরামত বা সার্ভিসিংয়ের সুবিধা থাকবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানালেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পিয়ারের ওপর সবশেষ ভয়াডাক্ট স্থাপন করা হবে এ মাসের মাঝামাঝিতে। ভায়াডাক্টের ওপরে ৭ কিলোমিটার রেল লাইন বসানোর কাজ হয়েছে। সর্বাধুনিক সুবিধা সম্বলিত স্টেশনগুলোর কাজও চলছে দ্রুত গতিতে।
উত্তরায় নির্মাণাধীন স্টেশন-৩ সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এর কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। টিকেট কাউন্টার, বিশ্রামাগার, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত খাবারের দোকান, নামাজের জায়গা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট, অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স রুম, বিনা টিকেটে বা টিকেটের অতিরিক্ত যাত্রী গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, এসকেলেটর বা চলন্ত সিঁড়ি, লিফট— কী আয়োজন নেই এই স্টেশনে! শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত যে আট পরামর্শক জীবন দিয়েছিলেন, তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভও থাকছে এই এলাকায়। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় কুড়িল বিশ্বরোডে নতুন বাজারের কাছাকাছি স্থানে এটি স্থাপন করা হবে।
বুধবার প্রকল্পটি সরেজমিনে ঘুরে দেখেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এসময় তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, যে গতিতে কাজ চলছে আশা করছি এর প্রথম অংশটি আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই চালু করা সম্ভব হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বিত প্রকল্পটি যেন জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার এর খরচও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। প্রকল্পটি মুনাফা অর্জনের জন্য হাতে নেওয়া না হলেও লস দিয়ে তো আর চালানো সম্ভব না। সবদিক বিবেচনায় নিয়েই মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হবে।
এসময় ডিপোতে একটি মিউজিয়ামের উদ্বোধন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। উত্তরা ডিপোতে স্থাপন করা এই মিউজিয়ামে ভায়াডাক্টের ওপর দিয়ে ডামি রেল চলাচল দেখার ব্যবস্থা। আছে প্রবেশ পথ, টিকেটিংসহ মেট্রোরেল সম্পর্কিত বিভিন্ন ডামি প্রদর্শনী। এছাড়া আছে মক ট্রেন, যেটি এর আগে জাপান থেকে এসেছিল।
মেট্রোরেল নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন সিদ্দিকী সারাবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে জাপানের অনেক সিনিয়র নাগরিক এখনো কাজে যোগ দিতে পারেননি। তাছাড়া রেলের ট্রায়াল রান দেখতে আমরাও যেতে পারিনি। জাপানের তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এটি দেখা হয়েছে। দেশে রেল কোচগুলো আসার পর আমরা পরীক্ষামূলকভাবে সেগুলো চালিয়ে দেখব।
তিনি জানালেন, এই ট্রায়াল রানের বিষয়টি কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে একবছর বা তারও বেশি সময় লেগেছে। তবে দ্রুততার সঙ্গে এই ট্রায়াল রান শেষ করে আগামী ১৬ ডিসেম্বর তারা প্রথম অংশ চালু করতে চান।
এম এন সিদ্দিকী আরও বলেন, করোনার আগে তিন শিফটে কাজ চললেও এখন দুই শিফট করে কাজ চলছে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে ২০২২ সালের মধ্যেই পুরো এমআরটি লাইন-৬ চালু করার।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর