২৫০ পরিবারের ঠাঁই রাস্তায়, কতদিন থাকবে জানে না কেউ
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:১৭
‘গত কাইল দুপুর পর্যন্তও ভাবি নাই, আমগোরে রাস্তায় নামতে অইবো। দুই পোলা আর আমি কাম-কাজ কইরে যে টাকা পাইতাম ওই দিয়েই ভালো গেছিল আমগো সংসার। কিন্তু মরার আগুন সব পুইড়া দিছে। কিচ্ছু নাই। সব কয়লা হই গেছে। অহন মাইনসের কাছে হাত পাতন লাগে। হারারাইত (সারা রাত) রাস্তার উপ্রে বসে কাটাইছি। কিচ্ছু নাই, গরিবের উপরই সব হয়..!’
বলছিলেন বস্তির পঞ্চাশোর্ধ্ব বাসিন্দা রাহেলা আক্তার। রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর মানিক নগর কুমিল্লা পট্টিতে আগুন লাগে। দেড় ঘণ্টার সেই আগুনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় কুমিল্লা পট্টি বস্তিটি। নিম্ম আয়ের প্রায় ২৫০ পরিবারের পাঁচ শতাধিক সদস্য বসবাস করতেন এখানে। প্রত্যেকেই ভাড়ায় বসবাস করতেন।
রাহেলা বেগম দু’মাস হয়েছে সেখানে ভাড়া নিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে উঠেছিলেন। কাজ করেন সায়েদাবাদ একটি গোডাউনে। অন্য জায়গার তুলনায় মানিকনগরের কুমিল্লা পট্টিতে কিছুটা কম ভাড়ায় রুম পাওয়ায় এবং নিজ জেলার পরিচিত অনেকে থাকায় ওই বস্তিতে বসবাস শুরু করেন তিনি। লাখ খানেক টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন ছেলেদের অগোচরেই- ছেলেদের ভবিষ্যতের জন্যই। তার ইচ্ছা ছিল আরও কিছু টাকা হলে গ্রামে চলে যাবেন এবং দুই ছেলের জন্য দুইটা অটোরিকশা (টমটম) কিনে দিবেন। এতে সুখেই বাকি জীবন কেটে যাবে তার। কিন্তু গরিবের যে সব ইচ্ছে থাকতে নেই, সে কথাই যেন বারবার বলছিলেন রাহেলা আক্তার।
সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে বস্তিতে গেলে রাহেলা বেগম প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমগো তো বড় কোনো ইচ্ছা নাই। শুধু একটু সুখে থাকনের লাইগা রাইতদিন কাম-কাজ করছি। এজন্যই কিছু টাকা জমাইতে পারছিলাম। কিন্তু মরার আগুন যে আমগো বাইচ্চা থাওনের সম্বলটাও কয়লা করে দিব কে জানতো?’
তিনি বলেন, ‘দুপুরে গোডাউনে কাজ শেষ করে ভাত খেয়ে একটু বসছি মাত্র। এ সময় পাশের বাসার বইনে ফোন দিয়ে কইল আগুন লাগছে। এটা বইলাই ফোন কাইটা দিছে। আমিও দৌড়ে আসছি। আইসা দেখি সব শেষ। শুধু আগুন জ্বলে। আমারে ঘরের কাছে যাইতে দেয় নাই। শুধু দূর থেইক্যা দাঁড়ায়ে ঘর পোড়া দেখতে হইল।’
তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিস আগুন নিভানোর পর ঘরের চিহ্ন খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়েছিল। জিনিসপত্র তো দূরের কথা। তারপর থেকে দুই ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় আছি।
বস্তির অপর বাসিন্দা নিলুফা খাতুনও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ মুগদায় একটা টেইলার্সের দোকানে কাজ করি। আগুন লাগার খবর পেয়ে দৌড়ে এসে দেখি শুধু আগুনের ফুলকি উড়তেছে। ভেতরে যেতে দেয়নি। দূর থেকে শুধু পোড়ার দৃশ্য দেখলাম।
তিনি বলেন, দেড় বছর আগে এখানে ভাড়া বাসায় উঠছি। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর একা থাকি। বেতনের টাকা জমিয়ে অনেক কষ্ট জিনিসপত্র কিনে একটা ঘর সাজিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তো এখন কিছুই নাই। পোড়া কপালে কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই, অন্তত গরিবদের…!
শুধু নিলুফা খাতুন বা রাহেলা বেগম নয়। এ বস্তিতে কেউ রিকশা চালায়, কেউ বা টং দোকান করে আবার কেউ গার্মেন্টেসে চাকরি করে। যাদের সম্বল বলতে বস্তিতে রাতে ঘুমানো আর তিন বেলা খাওয়ার জন্য যা যা উপকরণ প্রয়োজন, তা। কিন্তু নিষ্ঠুর আগুন তাদের সে সুখটুকুও সহ্য করল না। কেড়ে নিল সব। পোড়া আগুন সবকিছু ধ্বংসস্তুপ বানিয়ে থামল!
আগুনে নিঃস্ব হওয়া বস্তিবাসীর এখন ঠাঁই হয়েছে বস্তির সামনের রাস্তায়। এখানেই দিনরাত কাটছে তাদের। খাবার বলতে সহযোগিতাকারীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থে কয়েকজন মিলে দায়িত্ব নিয়ে তিন বেলা খিচুড়ি রান্না করে সবার মাঝে বিতরণ করছেন। একইসঙ্গে পোড়া বস্তি থেকে কোনো কাপড়চোপড় উদ্ধার করতে না পারায় আশপাশের বাসিন্দারা বস্তিবাসীর জন্য পুরাতন কাপড়চোপড় এনেছে। এতেই আপাতত দিনাতিপাত তাদের। তবে আজ কেউ কাজে ফিরেনি। শোকার্ত মনে কয়লা হওয়া ধ্বংসস্তুপের মাঝে তিল তিল করে গড়া থালা-বাটি-সম্বল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তারা।
দিনমজুর নুর মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইজ কামে যাইনি। পুড়ে যাওয়া ছাই থেকে জিনিসপত্র কিছু বের করতে চাইছিলাম। কিন্তু কয়লা ছাড়া তো কিছুই পেলাম না। তয় টিনগুলো বের করে আনছি।’
ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সামছুল হুদা সারাবাংলাকে বলেন, গতকাল রাত থেকে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আজ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং এখানকার এমপি এসে আরও কিছুদিনের খাবারের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে গেছেন। পাশাপাশি আজ মেয়রকে বিষয়টি অবহিত করে চিঠি দিয়েছি। তবে ক্ষতিগ্রস্থদের জানিয়েছি তারা চাইলে পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আপাতত অবস্থান নিতে পারবেন। কিন্তু তারা কেউ রাজি হয়নি।
তবে এ ঘটনার একদিন পার হয়ে গেলেও এখনো জানা যায়নি কিভাবে আগুন লেগেছে এবং কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, এখন তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি। তাই এ মুহুর্তে বলা যাচ্ছে না কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং কিভাবে আগুন লেগেছিল।
যদিও বস্তিবাসীর ধারণা একটি বাসার কাঠের চুলা থেকে এ আগুন লাগতে পারে।
সারাবাংলা/এসএইচ/এনএস