৭ মার্চ— স্বাধীনতার মন্ত্র যেদিন পেয়েছিল বাঙালি
৭ মার্চ ২০২১ ০০:১৭
ঢাকা: বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠেছিল— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উত্তাল বাঙালির রক্তে সেই লেগেছিল স্বাধীনতার নেশা। রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সমুদ্রে সেই স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজনীতির মহান কবি। আরও ১৯ দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেদিনের সেই ঘোষণাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে বাঙালির চূড়ান্ত অভিযাত্রার সূচনা।
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই উচ্চারণ বিশ্বকে জানিয়ে দেয়— বাঙালি জাতিকে আর ‘দাবায়ে’ রাখা যাবে না। বাঙালি জেনে যায়, পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সময় এসেছে। তাই ৭ মার্চের ভাষণ কোনো সাধারণ ভাষণ নয়— এটি বাঙালি জাতির রাজনৈতিক দলিল, এটি বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, বাঙালির মুক্তির সনদ। আর সে কারণেই জাতিসংঘের ইউনেস্কো এই ভাষণকে দিয়েছে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড ডক্যুমেন্টারি হেরিটেজ) ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’র স্বীকৃতি।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা। নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র আন্দোলনের বীজমন্ত্র ছিল সেই ভাষণ। সেই ভাষণটিই মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রেরণা দেয়। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে।
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস জয়ের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী টালবাহানা শুরু করে। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ১৯৭১ সাল আসতে আসতে মানুষ বুঝে গেছে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন শেষ। স্বায়ত্তশাসনও নয়, স্বাধীনতার বিকল্প নেই বাঙালির সামনে। তেমনই উত্তাল সময়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করে আওয়ামী লীগ।
মুক্তি সংগ্রামের আঁচ তখন সারাবাংলায়। আওয়ামী লীগের সেই জনসভায় তাই নামে মানুষের ঢল। ততদিনে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হওয়া বঙ্গবন্ধু ছিলেন সে জনসভার প্রধান অতিথি। ফলে সে জনসভায় নামে মানুষের ঢল। কী নির্দেশনা দেবেন নেতা— সেই নির্দেশনা শুনতেই রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে।
সেই জনসমুদ্রে যখন হাজির হলেন সাত কোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। ঘড়ির কাটায় ৩টা ২০ মিনিট। মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালের শেখ মুজিব। কেবল বাঙালি জাতিকেই নয়, গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, আমরা এখন মুক্তি সংগ্রামেরই কেবল অপেক্ষা করছি। বললেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের ওপর হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু— আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি— তোমরা বন্ধ করে দেবে।
ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে ঠিক সেই নির্দেশনা মেনেই দেশ পরিচালিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলাম, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ আজ তার অধিকার চায়।’ সেই অধিকার আদায় করে নিতে, মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে ৭ মার্চের ভাষণে নির্দেশনা দিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। আপামর জনতা সেই নির্দেশনা বুকে নিয়ে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে আরও শাণিত করে ঘরে ফিরে গেল দুর্গ করে তুলে শত্রুর মোকাবিলা করতে।
বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান ছাড়ছেন মঞ্চ থেকে, তখন মঞ্চে উপবিষ্ট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকের প্রধান আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মুহূর্তে মুহূর্তে তারা জনসমুদ্রের সামনে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন স্লোগান, জনতার মুখে সেসব স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে রেসকোর্স থেকে গোটা বাংলায়। সেদিন মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ আরও অনেকে।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধু বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান নয়, এটি সব জাতির মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিক-নির্দেশনা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষ’ ও ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’র শুভক্ষণে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালির মন-মননে চিন্তা-চেতনায় আদর্শ-অনুপ্রেরণায় স্বপনে-জাগরণে প্রদীপ্ত শিখা রূপে প্রবাহিত।
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দিনটি নিজেদের মতো করে বিভিন্ন কর্মসূচিতে পালন করবে।
সারাবাংলা/টিআর