শঙ্কা ছাপিয়ে শুরু প্রাণের বইমেলা
১৮ মার্চ ২০২১ ১৫:৪৭
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের শঙ্কা ছাপিয়ে শুরু হলো বাঙালির ভাষা-চেতনার দীপ্ত প্রকাশ অমর একুশে বইমেলা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে এবারের মেলা উৎসর্গ করা হয়েছে। আর বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।
বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) নিজের সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত হয়ে বইমেলা উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এরপর ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।
বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী করোনার কারণে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থাকতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নয়, বিরোধীদলীয় নেতা থাকার সময়েও কখনো বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মিস করিনি। বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নতুন প্রজন্মের বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। বলেন মেলায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথাও।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বক্তব্য দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. বদরুল আরেফীন।
ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ‘নিউ চায়না ১৯৫২’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২১ মনোনীতদের হাতে তুলে দেন।
বিকেলে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি বইমেলা উদ্বোধনের পরপরই মেলা উন্মুক্ত হয়েছে সবার জন্য।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী জানান, এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর একবছর ধরেই পালিত হয়েছে বাঙালি জাতির জনক, মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এমন একটি বছরে সবচেয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে বাঙালির সংস্কৃতির বড় উৎসব অমর একুশে বইমেলা পালিত হওয়াই ছিল কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু করোনা বাস্তবতায় নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে এবারের মেলা আয়োজিত হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মেলা চলবে চলবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত।
এদিকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মেলা শুরুর আগেই জানিয়েছিল, দেশব্যাপী নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বইমেলা ঘিরে অনিশ্চয়তা আছে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে যেকোনো সময়ই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়ে রেখেছিলেন আয়োজকরা।
অমর একুশে বইমেলা পরিস্থিতি বিবেচনায় শুরুর পর থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিনে বইমেলা খোলা থাকবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
এদিকে, বাংলা একাডেমি থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এবারের বইমেলায় মোট ৫৪০টি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছে ৮৩৪টি স্টল। মেলায় মোট প্যাভিলিয়ন রয়েছে ৩৩টি। এবারের বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরটি স্থানান্তর করা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণে। সেখানে ১৩৫টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি পাঁচটি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৪০টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই বিক্রি বা প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বইমেলায় বাংলা একাডেমি ও মেলায় অংশ নেওয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে।
মেলায় বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়ন থাকবে তিনটি। এর বাইরে শিশু-কিশোর উপযোগী বইয়ের জন্য একটি এবং সাহিত্য মাসিক উত্তরাধিকারের জন্য একটি স্টল থাকবে। এবারও শিশুচত্বর থাকবে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথমদিকে ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে না।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। অমর একুশে বইমেলা-২০২১-এর প্রচার কার্যক্রমের জন্য একাডেমিতে বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদীতে একটি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনটি তথ্যকেন্দ্র থাকবে। সাংবাদিকদের অবাধ তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধার্থে বইমেলায় মিডিয়া সেন্টার থাকবে তথ্যকেন্দ্রের উত্তর পাশে।
১৯ মার্চ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং গত একবছরে প্রয়াত বিশিষ্টজনদের জীবন ও কর্ম নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিদিনই থাকবে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ ও আবৃত্তি। অমর একুশে বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২০ বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এছাড়া ২০২০ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
বইমেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে। বইমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে পর্যাপ্তসংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলায় এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্বপ্রান্তে নতুন একটি প্রবেশপথ করা হয়েছে। প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল রমনা প্রান্তে একটি প্রবেশপথ ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা। এবার এটা করা সম্ভব হয়েছে। সবমিলিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে তিনটি প্রবেশপথ ও তিনটি বের হওয়ার পথ থাকবে। প্রতিটি প্রবেশপথে সুরক্ষিত ছাউনি থাকবে, যেন বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে মানুষ আশ্রয় নিতে পারেন। বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে।
সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই কর্তৃপক্ষ বইমেলায় তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, তথ্যকেন্দ্রের সর্বশেষ খবরাখবর এবং মেলার মূল মঞ্চের সেমিনার প্রচারের ব্যবস্থা করবে। মেলায় ওয়াইফাই সুবিধা থাকবে। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।
এছাড়াও মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মেলার তথ্য প্রতিদিন সরাসরি সম্প্রচার করবে। এফএম রেডিওগুলোও মেলার তথ্য প্রচার করবে। গ্রন্থমেলার খবর নিয়ে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি বুলেটিন প্রকাশিত হবে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রতিদিন মেলার তথ্য প্রচার করবে।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এমও/টিআর