হাসপাতালে বাড়ছে রোগী, বেডের জন্য হাহাকার
২৩ মার্চ ২০২১ ০৮:৪৬
ঢাকা: ‘গত কিছুদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই এখন অনেক জায়গা থেকে ফোন আসছে একটা বেড ম্যানেজ করে দেওয়ার জন্য। কেবিন বা অন্য সিট নয় বরং জেনারেল সিট যেখানে অন্তত চিকিৎসা নিতে পারবে। কিন্তু রোগী পরিপূর্ণ আমাদের এখানে। আজকেও একজন ফোন করেছেন আইসিইউ বেডের জন্য। কিন্তু সেখানেও কোনো সিট খালি নেই। আর নতুন করে তো কোনো আইসিইউ বেড রাতারাতি বসানো যায় না। এখন আসলে চুপ করে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি যারা এখানে আছে। কিন্তু যারা আসতে চাচ্ছে তাদের জন্য তো আর নতুন করে জায়গা দেওয়া সম্ভব না। এরপরও গত ২৪ ঘণ্টায় ৬০ জন রোগী ভর্তি করা হয়েছে। এরমধ্যে ২১ জনেরই পজিটিভ। বাকিদের উপসর্গ আছে প্রচুর মাত্রায়।’
সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই চিকিৎসক জানান, ওই হাসপাতালে এই মুহূর্তে কোনো আইসিইউ খালি নেই। আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি ৬৯ জন। কেবিনেও সিট খালি নেই। তিনটি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে ২৭৩ জন ভর্তি আছেন। যা হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এখানে মাত্র ৯৮ জন ভর্তি ছিলেন।
সন্ধ্যায় করোনা উপসর্গ থাকা একজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। পেশায় ব্যাংকার রাজিব আহমেদ গত তিনদিন থেকে উপসর্গ নিয়ে আজকেই একটি প্রতিষ্ঠানে নমুনা জমা দিয়েছেন। কিন্তু শরীর বেশি খারাপ বোধ করায় বাসা থেকে বের হয়ে আসেন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য। কারণ ফোনে কোনো স্থানেই তিনি একটা সিট খালি আছে এমন কোনো সংবাদ পাচ্ছেন না। বেসরকারি তিনটি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, কোনো সিট খালি নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও বেড খালি নেই বলে শুনেছেন। আর তাই সরকারি অন্য কোনো জায়গায় খালি আছে কিনা সেটি জানতে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখানেও কোনো সিট খালি নেই বলে জানতে পারেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এমন কোনো হাসপাতাল কী নেই যেখানে একটা জেনারেল ওয়ার্ডে হলেও বেড পাওয়া যাবে?
প্রায় একই অবস্থা রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও। নমুনা পরীক্ষার জন্য যারা আসছেন তাদের অনেকেই পজিটিভ শোনার পরে হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইছেন। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি রোগী।
২০ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরে রাজধানীর প্রায় সকল বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে জানতে পারেন কোথাও কোনো জেনারেল বেড বা কেবিন কিছু খালি নেই। আর এমন অবস্থায় তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সেখানেও প্রায় একই অবস্থা তখন।
শুধুমাত্র রাজধানীতেই নয়, প্রায় একই রকম অবস্থা চট্টগ্রামেও। বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলে জানা যায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই কিন্তু ধারণক্ষমতা আগেই পূর্ণ হয়ে থাকায় নতুন রোগীদের আর জায়গা করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
২২ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য বুলেটিন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালগুলো দুই হাজার ৩৪৯টি বেডের মাঝে শুধুমাত্র পাঁচটি বেড খালি আছে। এর মধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৭৫ জেনারেল বেডের ভর্তি আছেন ৩৯৩ জন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৯০৮টি বেডের মাঝে খালি আছে ৪৭টি আইসিইউ বেড। প্রায় একই অবস্থা চট্টগ্রামেও। সরকারি ও বেসরকারি ৬৮৭ টি বেডের মাঝে দেখা যায় মাত্র ২১টি আইসিইউ বেড খালি আছে।
দেশে সংক্রমণের হার বিগত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ৭ থেকে ১৩ মার্চের ১৪ থেকে ২০ মার্চ সংক্রমণ শনাক্তের হার বেড়েছে ৯১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা পরিস্থিতি খারাপে দিকে। আর এমন অবস্থায় যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের পাওয়া যাওয়ার সংবাদ আশঙ্কাজনক। একই সঙ্গে দেশের মানুষ যদি এখনও স্বাস্থ্য বিধি এড়িয়ে চলে মাস্ক না পরে তবে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ, আর তখন হাসপাতালে জায়গা দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সারাবাংলাকে বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট একটা কারণ হতে পারে তবে মূল কারণ কখনোই না।; এক্ষেত্রে সংক্রমণ বাড়ার জন্য মূলত দায়ী আমাদের জীবনাচরণে স্বাস্থ্যবিধিকে গুরুত্ব না দেওয়া। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জনসমাগম এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি এবং একই সঙ্গে মাস্ক পরাটাও। ভ্যাকসিন দেওয়ার পড়েও অনেকে রিল্যাক্স হয়ে ঘুরছে। এটাও বিপদজনক হয়ে উঠছে আমাদের জন্য। কারণ ভ্যাকসিন দিলেই সবার মাঝে অ্যান্টিবডি গড়ে উঠবে আর করোনা সংক্রমণ হবে না এমনটা কিন্তু কোথাও বলা হয় নাই। সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, আমরা যদি নিজেরা মাস্ক না পরি তবে ভ্যারিয়েন্টের দোষ কিভাবে দেবো? কারণ যে ভ্যারিয়েন্টই হোক না কেনো মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মানলে তো সেটি শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না। মাঝে দেশে মাস্ক পড়ার হার বেড়েছিল। একই সঙ্গে সামাজিক দুরত্ব ও ঘনঘন হাত ধোয়ার অভ্যাসও তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এখনও সেখানে কিছুটা রিল্যাক্স ভাব দেখা যাচ্ছে আর সেক্ষেত্রে সংক্রমণ বাড়ছে। এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানা কোনো বিকল্প নেই। মাস্ক ছাড়া গতি নেই। একইসঙ্গে সামাজিক দূরত্ব এবং ঘন ঘন হাত ধোয়ার যে অভ্যাস হয়েছিল সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারিভাবেও চিকিৎসাব্যবস্থা সুবিধা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটকে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সবার আসলে স্বাস্থ্যবিধিটা বেশি করে মানতে হবে যাতে হাসপাতালে কাউকে না আসতে হয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক সারাবাংলাকে বলেন, মানুষের মাঝে এখন অনেক রিল্যাক্স ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে বাড়ছে সংক্রমণও। আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলি তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণ আমাদের সীমিত সামর্থ্যে আমরা গতবার সফলভাবে মোকাবিলা করেছিলাম। এবারও করতে চাই কিন্তু যদি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তবে হাসপাতালগুলোতে জায়গা দিবে কিভাবে? এক্ষেত্রে তাই আমি জনগনের প্রতি আহবান জানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার।
সারাবাংলা/এসবি/এএম