Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদ্মাসেতুর অগ্রগতি ৯২%, যান চলবে ২০২২ সালের জুনে

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৫ মার্চ ২০২১ ২৩:২৫

ঢাকা: বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতু এরই মধ্যে দৃশ্যমান। এরই মধ্যে মূল সেতুর ৯২ শতাংশ কাজ শেষে হয়েছে। ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্যদিয়ে প্রমত্তা পদ্মার এপার-ওপারের মধ্যে বাধাহীন পথ তৈরি করেছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতু। চার লেনের এই সেতুর প্রস্থ ৭২ ফুট। তবে সম্পূর্ণ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৪ শতাংশ। গত জানুয়ারি পর্যন্ত অগ্রগতির এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি প্রতিবেদনে। আগামী বছরের জুনে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে। এজন্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০২২ সালের জুনে সেতুটি খুলে দেওয়ার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগিয়ে চলছি।’ মেয়াদ বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুরো প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। এজন্য আমরা দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছি।’


ফাস্টট্র্যাক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৩২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। নদী শাসন কাজ শেষ হয়েছে ৭৯ শতাংশ। এছাড়া সার্ভিস এরিয়া-২ এবং জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তের অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজসহ অন্যান্য কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে।

ফাস্টট্র্যাক প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের এ প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১১০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২২ দশমিক ২০ শতাংশ। এ অবস্থায় সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এক্ষেত্রে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে দুই হাজার ৯’শ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ ধরা হয়েছে দুই হাজার ৯৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বপ্নময় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অবকাঠামো ও পরিবহন সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থনীতি সুসংহত হবে। পণ্য ও মানুষের চলাচল অনেক বেশি সহজ হবে। সেতুটির নির্মাণ শেষ হলে প্রায় ১ থেকে দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে ব্যাপক বিনিয়োগ আসবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। সব মিলিয়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধিতে যাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘সেতুটি নির্মাণ শেষ হলে তা হবে জাতির জন্য এক বড় অর্জন। দেশের নিজস্ব অর্থে এত বড় অবকাঠামো এই প্রথম। ফলে জাতি হিসেবে আমাদের যে সক্ষমতা তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।’

পদ্মা সেতুর পেছনের ইতিহাস

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট একনেকে অনুমোদিত পদ্মাসেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা (১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। শুধু সড়ক সেতু নির্মাণের পরিকল্পনায় এর দৈর্ঘ্য হিসাব করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের শেষদিকে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পরে জানুয়ারিতেই সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়। ডিজাইন পরামর্শক কাজ শুরু করলে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১ হাজার মিলিয়ন ডলার, এডিবি ৫০০ মিলিয়ন ও জাইকা ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। সেতু বিভাগ ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রস্তাবিত চার লেনবিশিষ্ট সড়ক সেতুর ডিজাইন পরিবর্তন করে ডেনমার্কের একটি সেতুর অনুরূপ দ্বিতল সেতুর ডিজাইন প্রস্তাব করা হয়।

এর পর সেতু নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় সংশোধন করে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। ইস্পাতের তৈরি অবকাঠামোর ওপর নির্মিত চার লেনবিশিষ্ট সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে হবে রেলসেতু। ডিজাইন প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সম্ভাব্য ঋণও চূড়ান্ত হয়।বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন, এডিবি ৬১৫ মিলিয়ন, জাপান ৪৩০ মিলিয়ন ও আইডিবি ১৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং পরবর্তী সময়ে ঋণ চুক্তি সই করে। এরই মধ্যে সেতুর ডিজাইন অনুযায়ী প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা বা ২ হাজার ৯৭২ মিলিয়ন ডলার। সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি একনেকে অনুমোদিত হয়।

বিশ্ব ব্যাংকসহ উন্নয়নসহযোগীদের সরে যাওয়া

২০১১ সালের জুলাই-আগস্টে উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। এবং সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ স্থগিত করে দেয়। সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের একজন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করলে প্রধানমন্ত্রী তাদের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে বলেন। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে কানাডীয় রয়্যাল মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) কাছে অভিযেআগ করে। পরে তদন্ত করে আরসিএমপি কানাডীয় আদালতে মামলা করে। ২০১২ সালের ২৮ জুন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিক পদ্মাসেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।

উন্নয়নসহযোগীদের ফেরানোর প্রচেষ্টা

বিশ্বব্যাংককে পদ্মাসেতু প্রকল্পে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের কঠিন শর্তে রাজি হয়ে যায়। তখনকার সেতু সচিব মোশারফ হোসেন ভুঁইয়াকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয় এবং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করানো হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করে এবং বিশ্বব্যাংক নিয়োজিত তিন সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী আইনজ্ঞ প্যানেলের চাপে কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে। বিশ্বব্যাংক দুদকের কাজে সন্তুষ্ট হয় না। তারা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধেও মামলা করতে বলে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মাসেতুর কাজে ফিরে আসেনি।

প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় সিদ্ধান্ত

বিশ্বব্যাংকের গড়িমসির কারণে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালে সেতুর কাজ উদ্বোধন। ২০১৭ সালে নদীর বুকে পদ্মাসেতুর প্রথম স্প্যান স্থাপিত হয়। সবশেষ গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ৪১তম তথা শেষ স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে এখন পদ্মার বুকে দৃশ্যমান পুরো পদ্মাসেতু।

সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম

২০২২ সাল জুন পদ্মাসেতু যান চলাচল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর