২ বছর পর সাপ্তাহিক হাটের ‘স্বস্তি’ নানিয়ারচরে
৩১ মার্চ ২০২১ ২৩:০৯
রাঙ্গামাটি: আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের ‘অঘোষিত চাপে’ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বর্জনের দুই বছর পর রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার নানিয়ারচর বসতে শুরু করেছে বাজার। এতে স্বস্তি ফিরেছে বাজারের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে। গত দুই বছর ধরে বাজার চালু থাকলেও স্থানীয় পাহাড়িরা বাজার বর্জনের কারণে বিক্রেতারা দুর্বিষহ সময় কাটিয়েছেন। এখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ ফের আসতে শুরু করেছেন এই বাজারে।
আজ বুধবার (৩১ মার্চ) সাপ্তাহিক হাট বসে নানিয়ারচর বাজারে। বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনের পর থেকে অঘোষিতভাবে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার নানিয়ারচর বাজার বর্জন করে তিন ইউনিয়নের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল, পাহাড়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিবিরোধী সংগঠন প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ‘চাপে’ সাধারণ মানুষ বাজারে আসতে পারেনি। বাজার বর্জনের প্রধান কারণ তখনকার উপজেলা নির্বাচনে ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয়। ওই সময় উপজেলার ১ নম্বর সাবেক্ষং ইউনিয়ন, ২ নম্বর নানিয়ারচর সদর ইউনিয়ন ও ৩ নম্বর বুড়িঘাট ইউনিয়নের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ না আসায় দুর্ভোগে পড়েছিলেন ক্রেতানির্ভর এই বাজারের দুই শতাধিক ব্যবসায়ী।
একই কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এই তিন ইউনিয়নের পাহাড়ি মানুষদেরও। বাজার বর্জন করায় এই দুই বছর তাদের মহালছড়ি ও ঘিলাছড়ি বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্যসহ যাবতীয় পণ্য কিনতে হয়েছে, যা ছিল কষ্টকর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, ইউপিডিএফের চাপে স্থানীয় পাহাড়িরা বাজার বর্জন করেছে দীর্ঘ দুই বছর। আজ (বুধবার) সাপ্তাহিক হাট মিলেছে। প্রথম দিন মানুষ কিছু কম হলেও সামনের হাটের দিনে লোকজনের সমাগম বাড়বে।
তিনি বলেন, এর মধ্যে স্থানীয় ও ব্যবসায়ী নেতারা বাজার বর্জনের ডাক দেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে কথা বলেছেন। ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের কথা চিন্তা করে তারা বাজার বর্জনের ডাক প্রত্যাহার করেন। তাই প্রথম দিনের মতো আজ সাপ্তাহিক হাট মিলেছে।
সাবেক্ষ্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা চাকমা জনগোষ্ঠীর এক নারী জানান, এতদিন বাজারে না আসতে চাপ থাকায় কৃষি পণ্যসহ অন্যান্য মৌসুমি ফল বিক্রি করতে ঘিলাছড়ি ও মহালছড়িতে যেতে হতো। এখন নানিয়ারচর বাজারে পাইকাররা আসবেন। তাদের কাছে পাইকারি দরে ফল বিক্রি করতে পারব। দূর-দূরান্তে যেতে হবে না, দুর্ভোগ অনেক কমবে।
আরেকজন বলেন, সংসার চালাতে হলে বাজারে তো আসতেই হয়। কিন্তু ইউপিডিএফের চাপে বাজারে আসা যেত না। তারা গ্রামে-গ্রামে বাজার আসতে নিষেধ করেছিল। আমরাও তাই বাজার বর্জন করেছিলাম। এখন কিভাবে কী হলো, জানি না। তবে বাজার চালু হলো, আমরাও বাজারে আসতে শুরু করছি।
নানিয়ারচর বাজার ব্যবসায়ী পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি ঝিল্লোল মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, নানিয়ারচরে বাজারে দুই থেকে আড়াইশ দোকানপাট রয়েছে। দুই বছর ধরে পাহাড়িরা বাজার বর্জন করায় সাপ্তাহিক হাট মিলত না। এতে দুর্ভোগে পড়েছিলেন বাজারে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাবেক্ষ্যং, নানিয়ারচর ও বুড়িঘাটের বাসিন্দারা। এখন বাজার বর্জন প্রত্যাহার হওয়ায় তারা আবার বাজারে আসতে শুরু করেছে। এতে করে ব্যবসায়ীদের মাঝেও স্বস্তি ফিরেছে।
নানিয়ারচর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ইলিপন চাকমা জানান, বুধবার থেকে নানিয়ারচর বাজার চালু হলো। আমিও ফেসবুকে তাই দেখেছি। সাপ্তাহিক হাট চালুর এই সিদ্ধান্তটি খুব ভালো হয়েছে। এখন বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা সবাই উপকৃত হবেন।
নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) রাঙ্গামাটি জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রগতি চাকমা বলেন, ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ উপজেলা নির্বাচনে হারার ইস্যুকে কেন্দ্র করে নানিয়ারচর বাজার বর্জনের ডাক দিয়েছিল ইউপিডিএফ। কিন্তু এর আগে থেকেই তারা পাহাড়িদের বাজারে আসতে বাধা দিত। অবশেষে দুই বছর পর তারা বাজার বর্জন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। তারা (ইউপিডিএফ) এখন বুঝেছে, বাজার বর্জন করায় দিনদিন তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তাই বাজার বর্জন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ এতদিন বাজার বন্ধ করে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পাহাড়িদের কষ্ট দিয়েছে, আর কিছুই হয়নি।
তবে এ বিষয়ে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) কোনো নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
৩৯৩ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নানিয়ারচর উপজেলার দূরত্ব জেলা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার। ১ নম্বর সাবেক্ষ্যং, ২ নম্বর নানিয়ারচর, ৩ নম্বর বুড়িঘাট, ৪ নম্বর ঘিলাছড়ি— এই চার ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত রাঙ্গামাটির গুরুত্বপূর্ণ এই উপজেলাটি।
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, এ উপজেলার জনসংখ্যা ৪২ হাজার ৯৬৫ জন। তবে ভৌগলিক ও অবস্থানগত দিক দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে এটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ এক উপজেলা। পাহাড়ে বিরাজমান চারটি আঞ্চলিক দলের মধ্যে তিনটিরই আধিপত্য রয়েছে এই উপজেলায়। নানা সময়ে আধিপত্য বিস্তার, এলাকা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এই সংগঠনগুলো।
সারাবাংলা/টিআর