Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৬ দিনেই সংক্রমণ শনাক্ত এক লাখের বেশি, ভাঙলো মাসের রেকর্ডও

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৬ এপ্রিল ২০২১ ২২:৫৭

ঢাকা: দেশে এপ্রিল মাসে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ। এপ্রিল মাসের প্রথম ১৬ দিনেই এক লাখ ৪৮৪ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর আগে মাসের হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক অর্থাৎ ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল ২০২০ সালের জুন মাসে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিধিনিষেধগুলো কার্যকর করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি যদি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয় তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ শুক্রবারের (১৬ এপ্রিল) তথ্য বলছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৪ হাজার ৪১৭ জনের শরীরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ১৮ হাজার ৯০৬টি নমুনা পরীক্ষা করে এই সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০১ জন মারা গেছেন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে। যা বাংলাদেশে এক দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমিত ব্যক্তির মৃত্যুবরণ করার তথ্য।

মাস ভিত্তিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য
২০২০ সালের ২১ জানুয়ারিতে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের লক্ষ্যে নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর ৮ মার্চ প্রথম জানা যায়, দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির উপস্থিতি রয়েছে। ওই দিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানায়, ইতালি ফেরত দুজন এবং তাদের একজনের পরিবারের আরেক সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।

২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে সর্বমোট এক হাজার ৩১০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫১ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৫ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ৩.৮৯ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে দেশে সর্বমোট ৬২ হাজার ৮২৬টি নমুনা পরীক্ষা করে সাত হাজার ৬১৬ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ১৬৩ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১২.১২ শতাংশ।

২০২০ সালের মে মাসে দেশে সর্বমোট দুই লাখ ৪৪ হাজার ২৬৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৮২ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৪৮২ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১৬.১৭ শতাংশ।

২০২০ সালের জুন মাসে দেশে সর্বমোট চার লাখ ৬০ হাজার ৫৩০টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে এক হাজার ১৯৭ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ২১.৩৫ শতাংশ। মূলত এই মাসেই দেশে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের আগ পর্যন্ত।

২০২০ সালের জুলাই মাসে দেশে সর্বমোট চার লাখ ৭ হাজার ৩৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯২ হাজার ১৭৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে এক হাজার ২৬৪ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ২২.৬৩ শতাংশ।

২০২০ সালের আগস্ট মাসে দেশে সর্বমোট তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৫ হাজার ৩৩৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে এক হাজার ১৭০ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ২০.১৮ শতাংশ।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সর্বমোট তিন লাখ ৯৭ হাজার ৫৪৮টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫০ হাজার ৪৮৩ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৯৭০ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১২.৭০ শতাংশ।

২০২০ সালের অক্টোবর মাসে দেশে সর্বমোট তিন লাখ ৮৮ হাজার ৬০৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৪ হাজার ২০৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৬৭২জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১১.৩৮ শতাংশ।

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দেশে সর্বমোট চার লাখ ৩৬ হাজার ৪৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫৭ হাজার ২৪৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৭২১ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১৩.১২ শতাংশ।

২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে সর্বমোট চার লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৮ হাজার ৫৭৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৯১৫ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১০.৬৮ শতাংশ।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে সর্বমোট চার লাখ ২৪ হাজার ১২৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ২১ হাজার ৬২৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৫৬৮ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ৫.১০ শতাংশ।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সর্বমোট তিন লাখ ৯২ হাজার ৩০৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ১১ হাজার ৭৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ২৮১ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ২.৮২ শতাংশ। বাংলাদেশে মাসিক হিসেবে এই মাসে সব চাইতে কম সংখ্যক সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে এখন পর্যন্ত।

২০২১ সালের মার্চ মাসে দেশে সর্বমোট ছয় লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬৫ হাজার ৭৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে ৬৩৮ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে সংক্রমণের হার ছিল ১০.৩৯ শতাংশ।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম ১৬ দিনে দেশে সর্বমোট চার লাখ ৬৩ হাজার ৮২৪টি নমুনা পরীক্ষা করে এক লাখ ৪৮৪ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসের প্রথম ১৬ দিনে এখন পর্যন্ত এক হাজার ১৩৬ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে এ মাসে এখন পর্যন্ত সংক্রমণের হার ২১.৬৬ শতাংশ।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যা করণীয়
দেশে ২০২১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণ শনাক্তের হার বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়েও তারা সবাইকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়বেই। আর তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। সংক্রমণের উৎস ও উৎপত্তিস্থল বিশ্লেষণ করে তারপর সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।’

সরকারের আরোপ করা কঠোর বিধিনিষেধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. মোশতাক বলেন, ‘সরকার এর আগে আট-দশ দিনের জন্য কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছিল, সেগুলো সবাই খুব অনুসরণ করেছেন— এটি বলা যায় না। এর মধ্যে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে ১৪ এপ্রিল থেকে। এর আগের বিধিনিষেধের কোনো প্রভাব পড়েছে কি না, তা জানতে হয়তো আরও সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে কঠোর বিধিনিষেধের বিকল্প নেই।’

দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করা। নইলে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কমানো কঠিন। করোনাভাইরাসের সমস্যাটি এমন, প্রতিরোধ করেই একে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না পারলে পরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এখনো যদি আমরা এই বার্তাটি না বুঝি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলি, তাহলে আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’

সরকারের বিধিনিষেধ জারির বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে বলে মনে করে ডা. নজরুল। তিনি বলেন, ‘সরকার দ্বিতীয় দফায় লকডাউন ঘোষণা করছে— এমন প্রচারণা শুনছি। কিন্তু এই লকডাউন কী, সেটিই বুঝতে পারছি না। গার্মেন্টস, ব্যাংক খোলা রাখায় মানুষকে তো বের হতেই হবে। তাই আমার ধারণা, জনগণের কাছেও এই ধারণাটি স্পষ্ট নয়। আর সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করলে সেগুলো জনগণকে মানতে হবে। ফলে জনগণের কাছে নির্দেশনা স্পষ্ট করতে হবে। তারা মানছে কি না, সেটি কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। যারা মানছে না, তারাও যেন মানতে বাধ্য হয়, এমন ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তবে ডা. নজরুলও বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টি। তিনি বলেন, ‘সবাই যদি মাস্ক পরে, সবাই যদি অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো ঠিকমতো মেনে চলে, তাহলেই কিন্তু করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব ৯০ শতাংশের বেশি। ফলে মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে, না ধুয়ে চোখে-নাকে-মুখে হাত দেওয়া যাবে না, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। সবাই এগুলো অনুসরণ করলে পরিস্থিতি এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে আসবে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা লিমাও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণেই জোর দিতে বলছেন সবাইকে।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রধানতম করণীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বিশেষ করে মাস্ক পরার অভ্যাসটা চালু করা। কেউ মাস্ক পরে যদি বাইরে যান, তিনি হাঁচি-কাশি দিলেও কিন্তু মাস্ক তার কাছ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে। সেইসঙ্গে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে তার কাছ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা একেবারেই কমে যাবে। ফলে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধ মেনে চলুন। এর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধিটাও মেনে চলুন।’

সারাবাংলা/এসবি/এমও

করোনাভাইরাস শনাক্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর